বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও রেলওয়ের রানিং টাইম বেড়েছে

ব্যবস্থাপনার অসংগতি দূর ও সমন্বিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত হোক

বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৫৭ বছর অতিবাহিত করেও একটি সক্ষম জনব্যবসাবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারেনি। এর পেছনে উদাসীনতাকে এতদিন দায়ী করা হলেও বর্তমান সরকার নতুন মন্ত্রণালয় গঠন থেকে শুরু করে বিপুল বিনিয়োগ করেছে খাতে। বিভিন্ন প্রকল্পও চলমান। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, বিপুল বিনিয়োগের সুফল মিলছে না। সেবার মান আশানুরূপভাবে বাড়েনি, শিডিউল বিপর্যয় দুর্ঘটনাও বেড়েছে। গতকাল বণিক বার্তা জানিয়েছে, রেলের রানিং টাইমও বেড়েছে। আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে একই দূরত্ব অতিক্রম করতে। এটা নিঃসন্দেহে হতাশার খবর। রেলওয়ের বিনিয়োগ পরিকল্পিত নয়। যাত্রী বৃদ্ধি, আয়বর্ধক লাভজনক তিন বিবেচনায় প্রকল্প নেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নানা বিবেচনা কাজ করেছে। তাছাড়া আয়ের যে বিপুল সম্ভাবনা, তা ধরার কোনো উদ্যোগই নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথ সংস্কারের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষ। অথচ পথ দিয়ে চলা কোনো ট্রেনের গতি বাড়েনি। রেল পরিচালনার টাইম টেবিল বই অনুসারে, ২০০১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটাতেই ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। শুধু কুমিল্লার সদর রসুলপুর এলাকার কিছু অংশে ৭২ কিলোমিটার গতি ছিল। এখন পুরো পথেই ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। ১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প নেয়ার সময় বলা হয়েছিল, বাস্তবায়ন শেষে পথে ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু এখন চলে ৫০ কিলোমিটারেরও কম গতিতে।

রেলের নথিপত্রে আন্তঃনগর ট্রেনের ৯০ শতাংশ সময় মেনে চলছে বলে দেখানো হয়। আসলে প্রতিটি ট্রেনেরই চলাচলের সময় বাড়ানো হয়েছে। ফলে দেরিতে চললেও তা পুষিয়ে নেয়া যায়। এছাড়া বাস্তবতা হচ্ছে, আধা ঘণ্টা দেরিতে চলা ট্রেনকে সময় মেনে চলা হিসাবেই গণ্য করে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলে নতুন বগি, ইঞ্জিন দরকার। নতুন বিনিয়োগ, অবকাঠামোও দরকার। কিন্তু সবার আগে দরকার দক্ষ জনবল। রেলে এখন জনবলেরই ঘাটতি আছে। এছাড়া বিদ্যমান রেলসেবাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নও আছে। আমরা এখন যে দুর্ঘটনাগুলো দেখি, সেগুলো কিন্তু পরিচালনা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতির কারণে দুর্ঘটনা। চালকের ভুল কিংবা সিগন্যাল সিস্টেমের ত্রুটির কথাও উঠে আসছে। সবকিছুই কিন্তু পরিচালনাসংক্রান্ত বিষয়, অবকাঠামো নয়। তার মানে এখানে দক্ষ জনশক্তি দরকার। কিন্তু সেখানে বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগ আছে অবকাঠামোতে। মুহূর্তে রেল লাইনের সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু মেরামত ইত্যাদি কাজে নিয়মিত ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের এসব কাজে বাজেট কম। যদি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের পরিবর্তে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালানো যায়, তাহলে এক ট্রেন দিয়েই দুই ট্রেনের ট্রিপ দেয়া যায়। তখন আর এত বগি, ইঞ্জিন, ড্রাইভার লাগে না। এজন্য রেললাইনের সংস্কার, সিগন্যালের উন্নতি করতে হবে। কিন্তু সেখানে নজর কম। মেগা প্রজেক্টে টাকা বেশি, সবার নজরই সেখানে।

রেলের দ্রুত উন্নয়নের দাবি সর্বস্তরের মানুষের। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র যেখানে রেল ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে, সেখানে আমাদের দেশে রেল চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অনেক দেশে যখন ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার গতিতে চলছে ট্রেন, তখন আমরা ১০০ তো দূরের কথা, গতিবেগ ৬০ কিলোমিটারের ওপরই তুলতে পারছি না। ঘণ্টায় ১০০ কিলো গতিবেগ তুলতে পারলে অনেক মানুষ প্রান্তে নিজের গ্রামের বাড়িতে বাস করে ঢাকায় অফিস করে ফিরে যেতে পারত। ফলে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় জনচাপ কমত, যানজট কমে আসত, মানুষের আয়-ব্যয়ের একটা ভারসাম্য থাকত। যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রেল। সাশ্রয়ী কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে সাধারণ মানুষের চলাচল পণ্য পরিবহনের জন্য খাতের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমানে দেশের সড়কপথগুলো খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় রেলই হতে পারে সাধারণ মানুষের চলাচলের ভরসার স্থল। এজন্য রেলকে সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে যেতে হবে।

পাশের দেশ ভারতে রেলওয়ে খাতটি অন্যতম বৃহৎ লাভজনক সরকারি খাত হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে যে রেল খাত ছিল দেনায় জর্জরিত, মাত্র তিন বছরের মাথায় যথাযথ বিনিয়োগ করে ২০০৬ সালে ১৩ হাজার কোটি রুপি উদ্বৃত্ত দেখিয়ে ভারতের রেল খাতকে অন্যতম বৃহৎ লাভজনক পাবলিক খাতে পরিণত করেছে ভারতের রেল মন্ত্রণালয়। সাফল্য অর্জিত হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ রেল শ্রমিক কর্মচারীর বিশাল জনবল বহাল রেখেই। আসল কথা হলো, আর্থসামাজিক উন্নয়নে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে রেল খাতকে ভারতের কোনো সরকার অবহেলা করেনি। আমাদের একই পথে হাঁটতে হলে রোলিং স্টক বৃদ্ধি করা, কারখানাগুলোকে আরো কার্যকর করা, ট্রেন চলাচলে নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা, পণ্য পরিবহন বাড়ানো, টিকিট পেতে হয়রানি বন্ধ করা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা, ট্রেনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে নিয়মিত তদারক করার পাশাপাশি বিআরটিসির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস ট্রাক ব্যবহার করে স্টেশন থেকে যাত্রী পণ্য পরিবহন করতে হবে। কোনো অপারেশনের জন্য তিনটি উপাদান আবশ্যকীয়মেশিন, ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন এনভায়রনমেন্ট। রেলের তিনটি উপাদানই আজ অচল। ইঞ্জিন, জনবল আর স্টেশনতিনটিই রেলে সংকুচিত। এমন অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে রেলকে সাজাতে হবে। সেখানে সেবার মান বৃদ্ধি, রানিং টাইম হ্রাস, ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি প্রাধান্য পাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন