‘ওহ টাইগ্রিস, ওহ ইউফ্রেটিস’

এম এ মোমেন

নদীর নাম দজলা ও ফোরাত, বিশ্ব চেনে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নামে। এ দুই নদীর বন্দনায় স্মরণীয় সৃষ্টি ‘শাত-ইল-আরব’ রেখে গেছেন সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম—
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।
      যুঝেছে যেখানে তুর্কি-সেনানী,
      য়ুনানি, মিসির, আরিব, কেনানি-
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্ বেদুঈনেদর চাঙ্গা শির!
                                             নাঙ্গা-শির্-
শমেশর হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।

দজলা ও ফোরাতের ধারার সঙ্গে শাতিল আরব মিলিত হয়ে পারস্য উপসাগরে সমর্পিত হয়েছে।
ক্যারোলিন গ্র্যাসির ‘ওহ টাইগ্রিস, ওহ ইউফ্রেটিস’ কবিতার পুরোটাই দুটো নদীর আদ্যোপান্ত উপাখ্যান তুলে ধরেছে। এখানে খানিকটা অনূদিত হলো—
হে টাইগ্রিস আর্মেনিয়ার পর্বত থেকে নেমেছ
হে ইউফ্রেটিস, জন্ম তোমার কুর্দিস্তান
স্বর্গের বাগান সিক্ত করে, বিয়ের বন্ধনে দুই নদী
এক হয়ে বসরাতে চুমুক দিয়ে পানি সব ঢেলেছ
পারস্য সাগরে...
ওহ টাইগ্রিস, ওহ ইউফ্রেটিস দেখেছ প্রজন্মের পর
প্রজন্ম জেনারেলরা পা মাড়িয়েছে তোমাদের পবিত্র
তীরভূমিতে—সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রভাবের অতৃপ্ত ক্ষুধা
তাদের, তারা অন্যদের পরাস্ত করতে চায়
আলেকজান্ডারের পৌরাণিক লুণ্ঠন কাহিনী তারা ভোলেনি...

কারবালা ফোরাতের তীরে। কারবালার ক্রন্দনে সীমারের ছুরিও কেঁদে ওঠে। ফোরাতের তীরের বাগদাদ দখল করে নেয় একালের ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা।
২০০৫-এর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নির্দেশে ইরাকে যে আক্রমণ চালানো হয়, আমেরিকানরাও জানে তাদের পররাষ্ট্র নীতির সবচেয়ে বড় বিপর্যয় এটি। বুশ প্রশাসন যে ধারণাটি বিক্রি করতে চেষ্টা করেছে, তা হলো সাদ্দাম হোসেন গণনিধন অস্ত্র উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশনে বানাতে চেষ্টা করছেন, সন্ত্রাস ছড়াচ্ছেন। কোনোটাই সত্য প্রমাণিত হয়নি বরং তারা যখন নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, তা সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় ইসলামী জঙ্গি উত্থানের।
দজলা ও ফোরাতের দুই কূলে অশান্তি সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পুরনো অশান্তি প্রজ্বলিত করে অস্ত্র ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। দজলা-ফোরাতের অববাহিকায় যারা বসবাস করেন, মৃত্যুর সঙ্গেই তাদের বসবাস। তাদের বারবার স্বাধীন হতে হয়, একবার ঔপনিবেশিক শাসকের হাত থেকে, তারপর স্বাধীন হতে হয় আমেরিকার গ্রাস থেকে। আবার জঙ্গি ধর্মীয় শক্তির হাত থেকে।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী এবং তাদের শাখা-প্রশাখায় প্রবাহিত পানি ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও ইরাক। এসব নদীর উত্স তুরস্ক হওয়ায় দেশটির নদীভিত্তিক একাধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। শাতিল আরব ও টাইগ্রিসের সঙ্গে মিলিত হওয়া কয়েকটি শাখা নদীর উত্পত্তিস্থল ইরান হওয়ায় এসব নদীর প্রশ্নে ইরানেরও আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। এই নদী-পদ্ধতির ভাটির দিকে অবস্থিত হওয়ার কারণে ইরাক ও সিরিয়াকে প্রয়োজনীয় পানি লাভের নিশ্চয়তাই সবার আগে পেতে হয়। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধটা এখন পানির হিস্যা লাভের। হিস্যা আদায়ের লড়াই আগেও হয়েছে। পানির জন্য ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়।
টাইগ্রিস
ঘটনাটি ২১ মার্চ ২০১৯-এর, মসুল থেকে টাইগ্রিস পেরিয়ে ফেরিটির যাওয়ার কথা উজানের দ্বীপ উম্মাল রাবিনে; যাত্রীরা নওরোজ উত্সবে যোগ দিতে যাচ্ছেন। ফেরির ধারণক্ষমতা ৫০ জন, কিন্তু আরোহী ২০০ জনের বেশি। উজানযাত্রায় ফেরিতে চিড় ধরল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটি তলিয়ে গেল টাইগ্রিসের স্রোতে, পরদিনের হিসাব: ৫৫ জন উদ্ধার, ১০৩ জনের নিশ্চিত মৃত্যু এবং ৫০ জন নিখোঁজ।
ক্ষিপ্ত জনতা মসুলের গভর্নরের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে দায়ী করল, নিহতদের শেষকৃত্যের মিছিল থেকে গভর্নরের গাড়িতে ইট-পাটকেল মারা হলে অনেককে চাপা দিয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যান। এতে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ইরাক সরকার পরদিন ২৪ মার্চ তাকে বরখাস্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। টাইগ্রিস নদীর ওপর বাগদাদের আল আইমাহ সেতু। ৩১ আগস্ট ২০০৫ আল খাদিমিয়া মসজিদে শিয়া ইমাম মুসা আল কাজিমের মাজারে ওরস ও ধর্মীয় উত্সবে ছিল লাখো মানুষের জমায়েত। আগের দিন আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি দলের মর্টার আক্রমণে সাতজন নিহত হয়। মাজারের কাছে একটি গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে আত্মঘাতী বোমাবাজরা বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ সেতুর ওপর দিয়ে পাড়ি দেয়ার জন্য ছুটতে থাকে। শুরু হয় পদদলন, ওদিকে সেতুর রেলিং ভেঙে পড়লে শত শত মানুষ নদীতে পড়ে যায়। সেতুর ওপর এবং আশপাশে পদদলিত হয়ে ও নদীতে পড়ে ৯৫৩ জন তীর্থযাত্রী নিহত হয়। নদীতে পড়া তীর্থযাত্রীদের উদ্ধার করতে গিয়ে আরো ক’জন নিহত হন।
ইউফ্রেটিসের সঙ্গে জোড় বেঁধে একসঙ্গে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস বলা হলেও দুটো নদী সমান দৈর্ঘ্যের নয়। ইউফ্রেটিস ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার (১ হাজার ৭৪০ মাইল) এবং টাইগ্রিস ১ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার (১ হাজার ১৫০ মাইল)। টাইগ্রিস শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফারসি ‘টিগ্রা’ থেকে। টিগ্রা মানে দ্রুত কিংবা তীরসদৃশ।
টাইগ্রিস দক্ষিণ তুরস্কের তরাস পর্বতমালায় উত্পত্তি হয়ে আনাতোলিয়া ও ইরাক হয়ে নেমে এসেছে। এ নদীর তীরে অনেক প্রাচীন সভ্যতা সূচিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে মেসোপটেমীয় সভ্যতা।
টাইগ্রিসের জলবিধৌত অববাহিকার আয়তন ৩ লাখ ৭৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার (১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮৮ বর্গমাইল)। এ পানির উত্স গলিত বরফ ও শীতকালীন বৃষ্টি। বসন্তে বরফ গলন বৃদ্ধি পায়, ফলে স্রোত তীব্রতর হয়ে ওঠে। বরফ গলন ও বৃষ্টি ছাড়াও বহুসংখ্যক খরস্রোত জলধারা থেকে পানির সরবরাহ পেয়ে থাকে। এই স্রোতধারাগুলোর নাম হচ্ছে শাতাল হাই, শাতাল মুমিনাহ, মাজার আল কবির, আল মুশাররাহ, আল খালাহ, আল কাসারাহ ও শাতিল আরব। টাইগ্রিসের উত্স থেকে সাগরে সমর্পিত হওয়া পর্যন্ত বাম দিক থেকে বেরিয়ে গেছে আটটি শাখা নদী।
টাইগ্রিস নদীতে কখন বন্যা হবে আগাম অনুমান করা প্রায় অসম্ভব ছিল, সে কারণে এ নদীর তীরে যত শহর গড়ে ওঠার কথা, তা হয়নি। ব্যতিক্রম প্রাচীন অ্যাসিরিয়ার তিনটি রাজধানীর দুটি—নিনেভাহ ও কালাহ টাইগ্রিসের পূর্ব তীরে এবং আশুর পশ্চিম তীরে। অপিস নগরীর অবস্থান ছিল বাগদাদের কাছাকাছি টাইগ্রিসের তীরে।
বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ টাইগ্রিসের দুই তীরে ছড়িয়ে আছে আর ইরাকের বৃহত্তম বাঁধ মসুল এই নদীর পশ্চিম তীরে। নদীর একাংশে স্বল্প গভীরতার কারণে প্রাচীনকালে চলাচলের জন্য ভেলা ব্যবহার করা হতো, এখনো নদীপথে ভেলায় চড়ে মসুল যেতে হয়।
ইউফ্রেটিস
ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী ইউফ্রেটিস, এটি দীর্ঘতমও। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৪০ মাইল। টাইগ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছে মেসোপটেমিয়া (দুই নদীর মধ্যস্থলে ভূভাগ)। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা সৃষ্টিতে ইউফ্রেটিসের রয়েছে স্মরণীয় ভূমিকা। এ নদীর উত্স তুরস্ক। সিরিয়া ও ইরাকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শাতিল আরবে যুক্ত হয়েছে টাইগ্রিসের সঙ্গে। তারপর সমর্পিত পারস্য উপসাগরে।
প্রাচীন সুমেরীয়দের কাছে ইউফ্রেটিস ছিল ‘দ্য ব্লু রিভার’ আর ব্যাবিলনিয়ান ও অ্যাসিরিয়ানদের কাছে পুরাত্ত নদী। এই নদীর পানির প্রধান উত্স গলিত বরফ ও বৃষ্টি।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়াই একালের মানচিত্রের ইরাক—টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী স্থান—যা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট নামেও পরিচিত।
বাইবেলে বর্ণিত টাওয়ার অব বাবেলের ভিত্তিভূমি ব্যাবিলন গড়ে ওঠে ইউফ্রেটিসের তীরে।
সর্ববৃহত্ বাণিজ্য রুট সিল্ক রোডের অংশ ইউফ্রেটিস—এই রুট মধ্য এশিয়া ও মেসোপটেমিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। এ রুটে আলেপ্পো ছিল একটি মুখ্য বাণিজ্য বন্দর।
১৯৭৫-এ ইউফ্রেটিস নদীর ওপর তুরস্ক নির্মাণ সম্পন্ন করে কেবান বাঁধ এবং সিরিয়া সম্পন্ন করে তাবকা বাঁধ। তখন প্রচণ্ড খরায় ইরাকে পানিপ্রবাহ প্রায় অর্ধেক কমে গেলে ইরাক বোমা বর্ষণ করে তাবকা বাঁধ উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিলে আন্তর্জাতিক সংকট দেখা দেয়।
ইউফ্রেটিস জীববৈচিত্র্যের একটি কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল, এখন উন্নয়নের ছোঁয়ায় মানুষের লোভের বলি হয়েছে প্রকৃতি।
ইসলামে বর্ণিত হয়েছে, ইউফ্রেটিসের পানি শুকিয়ে যাবে, সেখানে উদ্ভূত হবে সম্পদ, আর তা-ই ডেকে আনবে কলহ ও যুদ্ধ। সহিহ বুখারীতে উল্লেখ করা হয়েছে, এ সম্পদ হবে স্বর্ণের পাহাড়।
ইউফ্রেটিস অববাহিকার পানির ৭০ ভাগের বেশি ব্যবহূত হয় ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কৃষিকর্মে। ইরাক অংশে ইউফ্রেটিসের পানি লবণাক্ত ও চাষে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের পর থেকে কুয়েত থেকে ইরাক পর্যন্ত মহাসড়ক ‘মৃত্যুর মহাসড়ক’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর মৃত্যুর মহাসড়কের গা ঘেঁষে ইউফ্রেটিস পেরিয়ে অন্তত ৮০ হাজার ইরাকি সৈনিক নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পেরেছে।
ইউফ্রেটিস ঘিরে একসময় রমরমা দাস বাণিজ্যও গড়ে উঠেছিল।
বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গ কোথায়?
স্বর্গের নাম গার্ডেন অব ইডেন। বাইবেলের জেনেসিস-এ বলা হয়েছে গার্ডেন অব গড। স্বর্গ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। হিব্রু বাইবেলে লিখিত হয়েছে নিজেদের নিষ্কলুষতার কারণে আদম ও ইভ নগ্ন হয়ে গার্ডেন অব ইডেনে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। স্বর্গের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত যে চার নদীর কথা বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে—মর্ত্যের নদী, সভ্যতার জননী টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসও সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে। কাজেই স্বর্গকে যদি পৃথিবীতে প্রতিস্থাপন করতে হয়, তা দজলা-ফোরাতকে ঘিরেই করতে হবে। অথচ এখানেই বিরাজ করছে নারকীয় পরিবেশ। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ হয়ে উঠেছে।
পানির জন্য যুদ্ধ
লাগাশ ও উম্মা—দুটি নগর রাষ্ট্র সাড়ে চার হাজার বছর আগে তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হলে লাগাশের শাসক এনান্নাতুম উম্মার ৬০ জন সৈনিককে ধরে এনে জবাই করে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
শহর দুটি এখনকার ইরাকে। কিন্তু কিসের নিয়ন্ত্রণ? টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস ইরাকের যে অঞ্চলে মিলিত হয়েছে, সেখানকার পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ যুদ্ধ। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণ ছিল পানি চুরি। সেবার উম্মা ভীষণ মার খেয়ে যায়। আমরাও বহুদিন ধরে শুনে আসছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
সাড়ে চার হাজার বছর আগে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী মানুষের যুদ্ধের যে হাতিয়ার ছিল তা বদলে গেছে, কিন্তু লড়াইয়ের বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি—যে পানি নিয়ন্ত্রণ করে, জমিজমাও সে নিয়ন্ত্রণ করে। ইতিহাসখ্যাত সেই দুই নদীর পানি
শুকিয়ে যাচ্ছে মূলত দুটি কারণে—পানির অতিরিক্ত উত্তোলন ও ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লাগাতার খরা। পরিবেশ পর্যবেক্ষক উপগ্রহ এটা স্পষ্টভাবেই উপস্থাপন করেছে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস অববাহিকায় অবস্থিত তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের কাছ থেকে নদী ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে এবং গভীরতা হারাচ্ছে।
টাইগ্রিসে নৌযান
১৮৩৬ সালে জেনারেল ফ্রান্সিস রাউডন চেসনি পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে পৌঁছার উদ্দেশে প্রথমবারের মতো দুটি স্টিমার টাইগ্রিস নদীতে প্রবেশ করালেন। টাইগ্রিস নামের স্টিমারটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হলো এবং ডুবে গেল। এতে ২১ নাবিকের মৃত্যু হলো। পরিত্যক্ত হলো অভিযান।
১৮৬১ সালে লিঞ্চ ব্রাদার্স ইউফ্রেটিস অ্যান্ড টাইগ্রিস নেভিগেশন কোম্পানি নামে জাহাজ  কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যাত্রী চলাচলের জন্য দুটি স্টিমার নিয়োজিত করে। ১৯০৮ সালে টাইগ্রিসে নিয়মিত চলাচল করা জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টিতে। পরবর্তী সময় প্রত্নতাত্ত্বিক সফরের প্রয়োজনে টাইগ্রিস রুটের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় টাইগ্রিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। জেনারেল টাউনস্যান্ডের সেনাবাহিনীর জন্য প্যাডলার জাহাজে সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করা হতো। বিশ শতকে টাইগ্রিসের ওপর বাঁধ, সেতু, রেলওয়ে ও সড়ক নির্মাণের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় টাইগ্রিসের নৌপথ বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর গুরুত্ব হ্রাস পায়। টাইগ্রিস জলবিদ্যুতের অন্যতম উত্স। কিন্তু তুরস্ক, ইরাক ও ইরানে অনেক বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় এবং এখনো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকায় পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
আমাদের স্মৃতির ফোরাত সৃষ্টি করেছেন মূলত দুজন। একজন কথাসাহিত্যিক, অন্যজন কবি। মীর মশাররফ হোসেন কারবালার মর্মান্তিক বাহিনী নিয়ে বিষাদ-সিন্ধু রচনা করেছেন একটি উপন্যাস হিসেবে। ফোরাত নদীর তীরেই কারবালার যুদ্ধ অথচ পানির অভাবে নবীজী (সা.)’র চুম্বনধন্য দৌহিত্র হাসান ও হোসেন এবং তাদের সন্তান-সন্ততির মৃত্যু যন্ত্রণা ও হাহাকারের বিবরণ পাঠ করে অশ্রুপাত করেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বাঙালি মুসলমানের কৈশোরের হূদয় বিদীর্ণ করা ‘মহররম’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের—
নীল সিয়া আসমান লাল লাল দুনিয়া—
‘আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।
...
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
ফোরাত প্রসঙ্গ কবিতায় আবারো এসেছে:
নিঃশেষ দুষমন্, ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের তীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
ইউফ্রেটিস বা ফোরাতের তীরে ১০ অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ (১০ মহররম ৬১ হিজরি) উমাইয়া খলিফা প্রথম ইয়াজিদের বিরাট সেনাদল এবং নবীজি (সা.)-এর দৌহিত্র ও হযরত আলী (রা.)-এর পুত্র হোসেনের স্বল্প সংখ্যক সৈন্যের একটি বাহিনীর মধ্যে কারবালা প্রান্তরে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটি রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়। উমাইয়া খলিফা প্রথম মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা দখল করে হোসেন (রা.)-এর আনুগত্য দাবি করে। হোসেনের অস্বীকৃতি সহিংস যুদ্ধ ডেকে আনে। তার অল্প ক’জন জনবলের এক কাফেলার বিরুদ্ধে ইয়াজিদের সহস্র সৈন্যের বাহিনী হযরত আলী (রা.)-এর বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে রণকৌশল হিসেবে কুফার পথে তাদের আক্রমণ করে এবং ফোরাত নদীর তীর অবরোধ করে রাখে। নারী ও শিশুসহ ৭২ জন নিহত হন।
কারবালা যুদ্ধ মুসলমানদের মধ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থান ত্বরান্বিত করে।

এম এ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন