পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ

সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা পরিবেশ অধিদপ্তরের

নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে অনুমোদনের অতিরিক্ত পাহাড় কাটার দায়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) ১০ কোটি ৩৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। গতকাল ঢাকার মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখার পরিচালক রুবিনা ফেরদৌসীর কার্যালয়ে শুনানি শেষে জরিমানা করা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং বহিঃসীমা দিয়ে লুপরোড নির্মাণসহ ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণশীর্ষক প্রকল্পের জন্য জরিমানা করা হয়। প্রকল্পটি শুরুর আগে সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড়, টিলা মাটি কাটার প্রয়োজন হতে পারে বলে নির্ধারণ করা হয়। আর নির্দেশনা মানার শর্তে সিডিএকে জাতীয় স্বার্থে সড়কটি নির্মাণের জন্য ছাড়পত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে গত শনিবার সড়কটি আবারো পরিদর্শনে গিয়ে তারা দেখতে পান, প্রায় ১০ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ ঘনফুট মাটিসহ ১৮টি পাহাড় কাটা হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। অর্থাৎ অনুমোদন-বহির্ভূতভাবে প্রায় আট লাখ ঘনফুট অতিরিক্ত পাহাড় কাটা হয়েছে। সেজন্য সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

সিডিএ সূত্রে জানা যায়, সিডিএরএশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং বহিঃসীমা দিয়ে লুপরোড নির্মাণসহ ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণপ্রকল্পটি প্রথম নেয়া হয় ১৯৯৭ সালে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৩ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৩২০ কোটি টাকা।

সিডিএর পক্ষে প্রকল্প পরিচালক ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন। একই বছরের নভেম্বর ইআইএর কার্যপরিধি অনুমোদন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের মার্চ প্রকল্পটির ইআইএ অনুমোদনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। ওই সময় প্রকল্পের ম্যাপ পর্যালোচনা করে কী পরিমাণ পাহাড়, টিলা মাটি কাটার প্রয়োজন হতে পারে, তা পর্যবেক্ষণের কথা জানায় পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে পাহাড় কাটার কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়নি তখন।

কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন না নিয়েই প্রকল্প পরিচালক মৌজার দাগ নম্বর ৩৫৭, ৩৫৮ ৩৫৯-এর কিছু কিছু অংশে আগেই পাহাড় কাটে সিডিএ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মে সরকারের অনুমোদন নিতে প্রকল্প পরিচালককে নোটিস প্রদান করা হয়। তবে বারবার সময় নিয়েও যথাসময়ে সরকারের অনুমোদনের আবেদন দাখিল করতে না পারায় অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাটার দায়ে সিডিএকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

পরবর্তী সময়ে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় পরিবেশ বন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ২৩ মে দুটি শর্তে রাস্তার অ্যালাইনমেন্ট বরাবর অবস্থিত পাহাড় কাটার জন্য অনুমোদন দেয়। শর্ত অনুযায়ী পাহাড় লেভেল ড্রেসিং কাটার কারণে ঢালের স্থায়িত্বের জন্য ঢালকে : অনুপাত রাখা, পাহাড়ের ঢালে জিওজুট ঘাস লাগানোসহ রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা, পাহাড় ড্রেসিংসহ সড়কটির নির্মাণকাজ করা হলে পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং ১৮টি পাহাড়ের অবস্থান সুরক্ষা পাহাড় ধ্বংস প্রতিরোধের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ঢাল প্রতিরক্ষার জন্য যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করে পাহাড় টিলা ড্রেসিং করতে হবে।

এদিকে গত বছরের ১২ মে সিডিএর সড়ক নির্মাণের প্রকল্পটির ইআইএ অনুমোদনসহ পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করে অধিদপ্তর। ছাড়পত্রে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটা হতে পারে এই পাহাড়ের মাটি ওই প্রকল্পেই ব্যবহার করা হবে এবং আগের দেয়া দুটি শর্ত মেনে চলার জন্য নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

তবে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষ সিডিএ বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এতে বলা হয়, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার বিএস দাগ নং ২০০ (অংশ), ৩০১ (অংশ) ৩০২ (অংশ)-এর উত্তর সীমানায় ৯০ ডিগ্রি সমকোণে ১০০ ফুট উচ্চতার পাহাড় অনিরাপদভাবে কাটা হয়েছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানে ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত আবাসিক হল নির্মাণ করা সম্ভব হবে না বলে জানানো হয়। তবে সিডিএর প্রকল্প পরিচালক অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষ পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানায়।

এদিকে গত শনিবার ২৫ জানুয়ারি হঠাৎ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় আবারো সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে অনুমোদিত লাখ ৫০ হাজার ঘনফুটের পরিবর্তে ১০ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ ঘনফুট পাহাড় কর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। দাখিলকৃতপাহাড় কাটা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাঅনুযায়ী পাহাড়ের ঢাল : অর্থাৎ ২৬ দশমিক ডিগ্রি কোণে পাহাড় কাটার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ পাহাড় ৯০ ডিগ্রি কোণে খাড়াখাড়িভাবে কাটা হয়েছে। কাটা পাহাড়গুলো মূলত বালুমাটির হওয়ায় কাটা পাহাড়ের বাকি অংশগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সময় তারা দেখেন বেশকিছু পাহাড়ে এরই মধ্যে ফাটল দেখা গিয়েছে। রাস্তার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।পাহাড় কাটা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাঅনুযায়ী পাহাড়ের ঢাল সুরক্ষার্থে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান অবস্থায় রাস্তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হলে পাহাড় ধসে ব্যাপক জানমালের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ছাড়পত্রের শর্তানুসারে প্রতি তিন মাস অন্তরপরিবেশগত পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনাবাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) . আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে জানান, সিডিএ সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও সরকারের নিয়ম না মেনে প্রকল্পের কাজ করেছে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের বর্তমান অবস্থার প্রতিবেদন, কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।

তিনি জানান, সিডিএ এক মাসের মধ্যে আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাবে। তারা আপিল করলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে অধিদপ্তর।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুন বণিক বার্তায়পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ সিডিএরশিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন