বিশ্লেষণ

আমরা কি সঞ্চয়হীন, ক্যাশহীন ও ব্যাংক সুদহীন ঋণী জাতি হব

ড. আর এম দেবনাথ

কয়েক বছর আগের কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এগুলোয় বসানো হয় প্রচুর বেতন-সুবিধার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিয়োগ দেয়া হয় অনেক ‘পরামর্শককে’। এসবই হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এবং তাদের অর্থ সাহায্যে। উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে লাভজনক করা এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে চলার পথ সুগম করা। ১৫-২০ বছর বিগত। এখন ব্যাংকগুলোর নাজুকাবস্থার কথা সবারই জানা। এসবের আগে দফায় দফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনর্গঠন এবং একে শক্তিশালীকরণের উদ্দেশ্যে দাতারা অনেক অর্থ সাহায্য দেয়। মাত্র কয়েকটি ডিপার্টমেন্টের বদলে এখন সেখানে কার্যরত ৪০-৫০টির মতো বিভাগ।

ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংক কোম্পানি অ্যাক্ট, ১৯৯১-তে দুনিয়ার সব ‘পাওয়ার’ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া আছে। এক্ষেত্রেও আইএমএফ নিত্যসঙ্গী। সম্ভবত এখনো তাদের টাকায় ওই ব্যাংকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। এদের অফিসও ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবনে। শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক সার্কুলার নাকি তারাই ড্রাফট করে দিত। পরিণতি কী? বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এখন অভিজাত হোটেলে বসে ব্যাংক মালিকরা নেন। খেলাপি ঋণে ব্যাংকিং খাত ডুবে আছে। আসা যাক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কথায়। বিদেশীদের পরামর্শে এর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আইসিবির অধীনে দু-তিনটি সাবসিডিয়ারি  কোম্পানি গঠন করা হয়। স্টক এক্সচেঞ্জের কাজে গতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার জন্য এখানে মালিকানাকে পৃথক করা হয় শেয়ার ট্রেডিং থেকে। এর পরিণতি কী? আমার মনে হয় না শেয়ারবাজার, স্টক এক্সচেঞ্জ, আইসিবি সম্পর্কে আলোচনার কোনো দরকার আছে। আরো খবর আছে। দাতাদের পরামর্শ ও শর্ত মোতাবেক শিল্পঋণের জন্য গঠিত দুটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করে নতুন একটি ব্যাংক গঠন করা হয়। উদ্দেশ্য, খেলাপি ঋণমুক্ত নতুন সংগঠনকে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পরিচালনা করা, যাতে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ ব্যাংক কর্তৃক সংগৃহীত ‘আমানত’ থেকে জোগাড় করা হয়। আগে সরকারি অর্থে শিল্পঋণ জোগাত বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা(বিএসআরএস)। এই দুুটোকেই একীভূত করে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।

ব্যাংকটি আছে কি নেই, আমরা ঠিক জানি না। মজা হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ডের অধিকাংশতেই আইএমএফ এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা প্রচুর অর্থ সাহায্য, কারিগরি সাহায্য জুগিয়েছে। টাকা-পয়সা দিয়ে, এমনকি তারা মিল-কারখানাও বন্ধ করিয়েছে/করাচ্ছে। বিখ্যাত আদমজী জুট মিলস এর উদাহরণ। শ্রমিক নেতাদের আনন্দ ভ্রমণে বিদেশে নিয়ে গিয়ে ওই ফাঁকে আদমজী জুট মিলস বন্ধ ঘোষণা করা হয় বলে তখনকার কাগজে খবর ছাপা হয়েছে। এই যে অর্থনৈতিক সব ঘটনা, এর সবই ঘটেছে বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। বাজার অর্থনীতি কতটুকু হচ্ছে আর কতটুকু হচ্ছে ‘উগ্র বৈষম্যকামী বাজার অর্থনীতি’, ‘ব্যবসায়ীবান্ধব অর্থনীতি’, তা এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন বাজার অর্থনীতিতে একের পর এক আঘাত হানছে, তেমনি ব্রেক্সিট হচ্ছে আরেকটি আঘাত।

আর আমরা ব্যাংকের সুদনীতি কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে বাজার অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দিচ্ছি। আবার পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে আইএমএফ, ইউরোপীয় দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দাতাদের মদদে আমরা এমন অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেখানে সঞ্চয়ের কোনো দাম নেই। ওইসব দেশের সমাজে ভোগ (কনজাম্পশন) হচ্ছে সমাদৃত। কেন এ কথা বলছি, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম সঞ্চয়পত্রের ঘটনা দিয়ে। আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন অর্থমন্ত্রী, তখন সঞ্চয়পত্রের ওপর আঘাত হানা শুরু হয়। সুদের হার কমানো হয়। অর্জিত সুদের ওপর উৎসে অগ্রিম আয়কর বসানো হয়। সঞ্চয়পত্র কেনার ঊর্ধ্বতম সীমা হ্রাস করা হয়। সঞ্চয়পত্র নবায়ন করার সুযোগ রহিত করা হয়। এর বিপরীতে ঋণ নেয়ার যে সুযোগ ছিল, তাও বন্ধ করা হয়। এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নতুন একটি সঞ্চয়পত্র প্রবর্তিত হওয়ায় কিছুটা রক্ষা। এর নাম পরিবার সঞ্চয়পত্র, যা নারীর ক্ষমতায়নে কাজে লাগছে। এসব কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছিল সঞ্চয়পত্র বলে কিছুই থাকবে না। কারণ বিশ্বাস করা হচ্ছে সঞ্চয়ের কোনো দরকার নেই। রোজগারের টাকার সব যাবে বাজারে। কনজাম্পশন আর কনজাম্পশন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো। সেখানে নাগরিকদের সঞ্চয় না করলেও চলে। বিপদে আপদে রাষ্ট্র নাগরিকদের দেখাশোনা করে। মনে হচ্ছিল এটাই আমাদের লক্ষ্য।

এটা পরিষ্কার হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক পরামর্শকের কথায়। তিনি মন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের সামনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বললেন, সঞ্চয় করে যারা, তারা আলস্যে সময় কাটাতে চায়। তারা অবসর গ্রহণের পর পায়ের ওপর পা তুলে খেতে চায়। তিনি আরো বলেন, সঞ্চয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তার বেতন-ভাতাও আইএমএফ কর্তৃক পরোক্ষভাবে প্রদত্ত। এসবের মাঝেই মিডিয়ার একাংশও সঞ্চয়পত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বলে প্রতীয়মান হয়। সবাই যেন চায় দেশে ভোগ বাড়ুক। এ ধারণা ইদানীং আরো শক্ত হচ্ছে। কয়েকটি ঘটনার কথা বললেই তা বোঝা যাবে। যেমন নয়-ছয় সুদনীতি এবং ক্যাশলেস সোসাইটির ধারণা।

এ বিষয়ে যাওয়ার আগেই বলে রাখা দরকার সঞ্চয়পত্র যতটুকু আছে, তাও থাকবে না! একে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ওপর অর্জিত সুদে করের হার বাড়ানো হয়েছে। বেচাকেনায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দৈনিক বণিক বার্তার খবর—এরই মধ্যে সঞ্চয়পত্রের বেচাকেনা এক-চতুর্থাংশে হ্রাস পেয়েছে। সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। তাহলে মানুষ তার সঞ্চয়ের টাকা কোথায় রাখবে? একটা জায়গা থাকে সব দেশে। আর তা হচ্ছে শেয়ারবাজার। এ শেয়ারবাজার গত ১০-১৫ বছরের মধ্যে দু-দুবার লুটপাটের শিকার হয়েছে।

কোনো বিচার-আচার হয়নি। শেয়ারবাজারের সূচক এখন ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। অতএব, সঞ্চয়কারীদের যাওয়ার জায়গা থাকে আরেকটি। আর সেটি হচ্ছে ব্যাংক। অবশ্য জমি আছে, ফ্ল্যাট আছে, আছে সোনাদানা ও ডলারও। তবে এসব সাধারণ সঞ্চয়কারীর জন্য খুব বেশি উপযুক্ত নয়। সমস্যা হচ্ছে ব্যাংক নিয়ে। আগে ব্যাংকে টাকা রাখলে মোটামুটি কিছু সুদ পাওয়া যেত। ১২-১৩-১৪ শতাংশ সুদও পাওয়া গেছে। এটা কমতে কমতে ৬-৭ শতাংশে নেমেছে। তবে সরকারি ব্যাংক দেয় মাত্র ৬ শতাংশ। এর বিপরীতে মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৬ শতাংশের ওপর। তার অর্থ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কোনো সুদ দেয় না, বেসরকারি ব্যাংকের কোনো কোনোটি ৮-৯ শতাংশ সুদ দেয়।

কিন্তু এদের শক্তি-সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে স্বয়ং নয়-ছয় নীতি। আগামী এপ্রিল থেকে নয়-ছয় সুদনীতি কার্যকর হবে। অর্থাৎ আমানতের ওপর সুদের হার হবে ৬ শতাংশ। তবে কথা আছে। সঞ্চয় হিসেবে নিশ্চিতভাবে সুদ হবে আরো কম। অথচ এখানে আমানত আছে মোট আমানতের প্রায় ২০-২৫ শতাংশ।

আবার এও ঠিক যে এই আমানত অনেকটা মেয়াদি আমানতের মতো। কেউ টাকা তোলে না বিপদে না পড়লে। এমন আমানতে যদি ২-৪ শতাংশ সুদ দেয়া হয় তাহলে তার অর্থ হচ্ছে কোনো সুদ না দেয়া। কারণ মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে ৬ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে আরো অনেক ‘কাট’। আয়কর কাটা হবে। নানা ধরনের চার্জ নেবে ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে। একসময় হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখলে উল্টো ব্যাংককে টাকা দিতে হবে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়ার জন্য। এ অবস্থায় লোকে হয়তো বাড়িতেই ‘ক্যাশ’ রেখে দেবে। কিন্তু এখানেও সমস্যা। ক্যাশ দিয়ে কী হবে? আমরা তো ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ করতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে নিয়ম হয়েছে, যতদূর মনে পড়ে, ৫ লাখ টাকার উপরে নগদ লেনদেন হবে না।

এছাড়া ‘বিল পেমেন্ট’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পাওনা-দেনা ফয়সালায় ব্যবহার হচ্ছে চেক ইত্যাদি। এতে দেখা যায় ক্যাশ উঠেই যাবে। তাহলে করণীয়? সঞ্চয়পত্র নেই, শেয়ারবাজার নেই, ব্যাংকে টাকা রাখা লোকসান। ক্যাশও রাখা যাবে না। এখানেই হচ্ছে বাজার অর্থনীতির মূলকথা। বাজারে লোক দরকার। শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, বিমান, রেল, হোটেল-মোটেল সর্বত্রই কাস্টমার দরকার। গাড়ি-বাড়ি, মোটরসাইকেল, ভোগ্যপণ্য ও প্রসাধনী সামগ্রী, অভিজাত পণ্য ইত্যাদির কাস্টমার দরকার। নতুন নতুন পণ্য আসছে বাজারে। নতুন স্টাইলে চুল কাটা, নতুন ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদির কাস্টমার দরকার। বিলাসবহুল কতসব সেবা পণ্য প্রতিদিন বাজারে আসছে। এসবের কাস্টমার দরকার। স্বর্ণ-ডায়মন্ডের কাস্টমার দরকার। ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদির কাস্টমার দরকার। সব মানুষই যদি সঞ্চয় করে তাহলে এসব পণ্য ও সেবা কিনবে কে? রোজগারের বড় অংশ যদি মানুষ সঞ্চয় করে, ব্যাংকে রাখে, সঞ্চয়পত্র কিনে, ক্যাশে রাখে তাহলে বাজারের পণ্য কে কিনবে?

বাজারে ক্রেতা দরকার। এর জন্য শুধু রোজগারের টাকায় হবে না। হচ্ছে না। অতএব, ঋণের ব্যবস্থাও আছে। ঋণের টাকাও বাজারে। পণ্যের জন্য, বাড়ির জন্য, বিয়ে-শাদির জন্য, অধ্যয়নের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঋণ এবং রোজগারের টাকা দুটোই যাবে বাজারে। তাহলেই হবে। বাজার অর্থনীতি করপোরেশনগুলো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হবে। কেউ বাড়ি বানাবে ১০-১৫ হাজার কোটি টাকায়।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন: সঞ্চয় কি এর জন্যই নিরুৎসাহিত? ক্যাশলেস অর্থনীতি, সঞ্চয়পত্রহীন বাজার, সুদহীন আমানত ইত্যাদি কি বাজার সৃষ্টির প্রয়াস? এর অর্থ দাঁড়াবে—খাও দাও ফুর্তি করো। কিছুদিন আগে সরকারের প্রভাবশালী এক নেতা তাই বললেন, এ তো চার্বাকীয় নীতি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক চার্বাক বলেছিলেন, ‘ঋণং কৃত্বা ঘিতং পিবেৎ, যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ।’ ‘ঘি খেতে হবে, ঋণ করে হলেও। যতদিন বাঁচা ততদিন সুখের মধ্যে বাঁচা।’ আমাদের কবীর-লালন-রবীন্দ্রনাথের সমাজ এই চার্বাকীয় নীতি গ্রহণ করেনি। করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত দেশগুলো। আমরাও কি তাহলে চার্বাকীয় অর্থনীতির শেষ যাত্রী হব? সঞ্চয়হীন, ক্যাশহীন ও ব্যাংক সুদহীন ঋণী জাতি—ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের মতো? এ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎই দেবে।

 ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন