সময়ের ভাবনা

বাসযোগ্য নগর ও ঢাকা সিটি নির্বাচন ২০২০

মো. আবু রায়হান

অভাগা নগরীঢাকা অভিভাবক নির্বাচনের প্রক্রিয়া বেশ উৎসবমুখর পরিবেশেই চলছে। প্রার্থীরাও ভোটযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত। আয়েশি জীবনযাপন ছেড়ে অনেকেই নির্বাচনী মাঠ দখলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ছুটছেন গণমানুষের কাছে। হাসিমুখে ভোট ভিক্ষার সঙ্গে হাজারো প্রতিশ্রুতি তাদের। নির্বাচিত হলে ঢাকায় যানজট কমাবেন; পানি, বিদ্যুৎ গ্যাস সংকট বা সমস্যা থাকবে না; বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করবেন; হোল্ডিং ট্যাক্স কমবে। আরো কত কী! ডলার ব্যয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের প্রচারণা উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিত হওয়ার পরে গণমানুষের কাছে ছুটে যাওয়া এবং নাগরিক সমস্যা সমাধানে এমন তত্পর নগর পিতাকেই চায় ঢাকাবাসী।

স্থপতি, নগর পরিবেশবিদরাবাসযোগ্য ঢাকাকথাটি বিভিন্নভাবে বলে থাকেন। আজকাল রাজনীতিক অর্থাৎ আমাদের হবু নগর পিতাদের মুখে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে শব্দগুলো। কেউ কেউ আবার মানবিক নগরী, স্মার্ট, আধুনিক ঢাকা, সবুজ ঢাকা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে আপাতত ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন মানুষের দুয়ারে। বিজ্ঞানের উত্কর্ষের যুগে প্রযুক্তিগত সুবিধা গ্রহণ খারাপ কিছু নয়। তবে এর অপব্যবহারও আমাদের কাম্য নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থীরা প্রচারণায় প্রযুক্তির যে নানামুখী অপব্যবহার দেখিয়েছেন, বর্তমানেও তার কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটছে না; বরং ঢাকা সিটি নির্বাচন ২০২০-এর প্রচারণায় এক ধাপ এগিয়ে আছেন মেয়র, কাউন্সিলর প্রার্থী তাদের সহযোগীরা।

ঢাকায় কাকডাকা ভোর থেকে কোনো কোনো এলাকায় রাত অবধি মাইকে জোর প্রচারণা চলছে—‘অমুক ভাইয়ের সালাম নিন-অমুক মার্কায় ভোট দিন।সঙ্গে নির্বাচন উপলক্ষে রেকর্ড করা গানগুলোও মাইকে বাজানো হচ্ছে বিকট শব্দে। কয়েক দিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অসংখ্য শিক্ষার্থীকে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। কিন্তু ঢাকায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাসাবাড়িতে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছে না মাইকের বিরক্তিকর শব্দের কারণে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালায় বেলা ২টার আগে উচ্চ শব্দের যন্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬- উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অনেক এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে অস্থায়ী মঞ্চে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। এতে দীর্ঘ জ্যাম সৃষ্টি এবং মানুষের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটছে। অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিধিমালা, ২০১৬- কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণের চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পোস্টার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীর বড় হাতিয়ার। কিন্তু কত পরিমাণ কোথায় তা প্রচার করা যাবে তার নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। কেননা বর্তমানে ঢাকার এমন কোনো অলিগলি নেই, যেখানে সিটি নির্বাচনের পোস্টার নেই! শুধু তাই নয়, বর্তমানে প্রার্থীরা পলিথিনসহ পোস্টার (লেমিনেটেড পোস্টার) ব্যবহার করছেন দেদার। ফলে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। নির্বাচন অন্যান্য ক্ষেত্রে লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহার বন্ধে সম্প্রতি হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা মূলত অবজ্ঞা করছেন সিটি নির্বাচনের অধিকাংশ প্রার্থী। তাহলেবাসযোগ্য নগরীকারা বাস্তবায়ন করবেন?

এদিকে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা প্রার্থীদের গলায় নির্বাচনী আচরণবিধির ফর্দ ঝুলিয়ে দিয়ে নির্বাচনের আনুষঙ্গিক গোছানোয় ব্যস্ত। প্রচারণা মনিটরিং, নিয়মের ব্যতিক্রমকারীদের নোটিস বা শোকজ যত সামান্যই হয় লোক দেখানো। ফলে প্রার্থীদের সমর্থক গোষ্ঠী বেপরোয়া প্রচারণায় মগ্ন হয়ে আছে। মুখ বুজে সহ্য করলেও অধিকাংশ মানুষ অতিষ্ঠ নির্বাচনের এমন নিয়মবহির্ভূত বেপরোয়া প্রচারণায়। রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এমন আচরণ সাধারণ মানুষের জন্য বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে। অথচ সেদিকে লক্ষ নেই কারো।

পৃথিবীর বসবাস অনুপযোগী শহরের মধ্যে ঢাকা এখন অন্যতম। লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের মতে, ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে মাত্র দুটি সিটি। এর একটি সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দামেস্ক, অন্যটি নাইজেরিয়ার লাগোস। নগরবিদরা ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী নগরীর অধঃপতনের কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণকে মনে করছেন। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে আবাসন তৈরি, আবাসিক এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মাণ, পানির প্রাকৃতিক আধারনদী, খাল এবং পুকুর দখল ভরাট, যানজট, বায়ু-শব্দ-পরিবেশ-পানি দূষণে জর্জরিত আমাদের প্রাণের ঢাকা। গরমে বিদ্যুিবভ্রাট আর শীত এলেই গ্যাস সংকট, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব, আরো কত কী। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বায়ুদূষণ। শহরের বাতাসের যে অবস্থা, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের দিল্লির মতোঅক্সিজেন বারবসাতে হবে। নাগরিকদের টাকা দিয়ে অক্সিজেন কিনে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। জনগণের আধিক্য, ‘ঢাকাযেন পরিবার পরিকল্পনাবিহীন একটি যৌথ পরিবার! বিশাল জনগোষ্ঠীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত চাট্টিখানি কথা হওয়ার নয়! তবুও নিকট অতীতে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক আশার সঞ্চার করেছিলেন কিন্তু ঢাকাবাসী দুর্ভাগা আর ঢাকা অভাগা, যে কথা শুরুতেই বলেছি। ইতিহাস ঘাঁটলে আরো ভালো এবং সফল মেয়রদের নাম জানা যাবে। তবে আনিসুল হক ব্যতিক্রম ছিলেন।

বলা যায় চতুর্মুখী চাপে এখন বিপর্যস্ত নগরজীবন। উত্তরণে নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং চলমান সমস্যাগুলো আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাসরত নগরীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জেঁকে বসেছে বিভিন্ন মরণব্যাধি, যা ক্যান্সারের মতো ছড়াচ্ছে ঢাকার সর্বাঙ্গে। যেদিকে তাকাই সংকট, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা। উন্নত নাগরিক সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১১ সালে ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত (ঢাকা উত্তর ঢাকা দক্ষিণ) করার মাধ্যমে যে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়, তার প্রকৃত সুফল জনগণ পাচ্ছে না। বরং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৈন্যের দরুন ঢাকার ভবিষ্যৎ ক্রমে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এই চাপ ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। মেয়র প্রার্থীরা কি এসব ভাবছেন? নাকি ক্ষমতার মসনদে আরোহণে চিত্রনাট্য মঞ্চস্থ করছেন, যেখানে বিদ্যমান আইন, নিয়ম, শৃঙ্খলা গৌণ বিষয় মাত্র!

হবু মেয়রদের তাই বলতে হয়, শহরের মানুষকে নির্মল বাতাস ফিরিয়ে দিতে বায়ুদূষণ রোধে কী করবেন; শিশুদের খেলাধুলা, অবসরযাপন, চিত্তবিনোদনের জন্য ঢাকার বিদ্যমান মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান গণপরিসর সংরক্ষণ বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ কী হবে; কী ভাবছেন কচ্ছপ গতিতে ক্রমে ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ার উপক্রম হওয়ার অন্যতম কারণযানজটনিয়ন্ত্রণে। মানসম্মত গণপরিবহনের হাহাকার আর বাদুড়ঝোলা হয়ে মানুষ শহরে আর কতদিন যাতায়াত করবে? আশা করি, বিআরটি, এমআরটি প্রকল্পকে কুমিরের এক বাচ্চার মতো তুলে ধরবেন না! বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী, খাল, পুকুর পানির প্রাকৃতিক আধারগুলো দখল দূষণমুক্ত করতে আপনার পরিকল্পনা কী? নগরে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যা সমাধানে কী করবেন? বড় প্রশ্ন হলো, আপনি কি পারবেন ঢাকার প্রায় অর্ধশতাধিক সেবা প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে?

ঢাকাবাসীকে যোগ্য নগরপিতা বাছাই করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে দল-মতের ঊর্ধ্বে গিয়ে জনস্বার্থে চ্যালেঞ্জগুলো হবু নগরপ্রধানকেই নিতে হবে। যদি তিনি বা তারা না পারেন, তবে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য আইন লঙ্ঘন নীতিবিবর্জিত যেসব কাজ নগরপিতা হওয়ার আগেই করছেন, এতে অসুস্থ ঢাকাকে সচল করার দায়িত্ব তার বা তাদের কাঁধে দিয়ে আস্থা রাখা মুশকিল।

 

মো. আবু রায়হান: উন্নয়নকর্মী

[email protected] 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন