নির্মাণ ত্রুটিতে সড়ক-মহাসড়কে ঢেউ

মানসম্পন্ন সড়ক নির্মাণে ব্যর্থতার দায় সওজ এড়াতে পারে না

উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু কোথাও কোথাও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে দেশের সড়ক বা মহাসড়কগুলো নির্মাণের পরও তা বেশিদিন টিকছে না। বছর না ঘুরতেই নতুন সড়ক ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ছে। খানাখন্দ আর কার্পেটিং উঠে চলাচলের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। একটি সড়ক নির্মাণ করার পর কোনো রকম মেরামত ছাড়াই তা টানা ১৫ বছর ভালো থাকবে, এটা ধরে নিয়েই সড়কের নকশা নির্মাণকাজ করার রীতি। অথচ নির্মাণের পর এক বছর না পেরোতেই সড়ক-মহাসড়কের স্থানে স্থানে ভেঙে যায়, খানাখন্দ সৃষ্টি হয়। ফলে বছর না ঘুরতেই সেগুলো মেরামতের প্রয়োজন দেখা দেয়। মেরামতের কাজও ভালোভাবে করা হয় না। তাই সেগুলো টেকসই হয় না। অবিরাম চলে মেরামতের কাজ আর এতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হতে থাকে। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ মেরামতে বিপুল অংকের অর্থের অপচয় একটা স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণ ত্রুটিতে সড়ক-মহাসড়কে এবড়োখেবড়ো অবস্থা বিরাজ করছে। কোথাও দেবে যাওয়া আবার কোথাও স্বাভাবিক থাকায় সড়কের পিচ হয়ে ওঠে ঢেউয়ের মতো, যাকে প্রকৗশলীদের ভাষায় বলা হয়আন্ডুলেশন এসব সড়ক-মহসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, বাড়ছে দুর্ঘটনাও।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিযোগিতা সক্ষমতাবিষয়ক সমীক্ষায় সড়কের মান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় কোন দেশের সক্ষমতা কেমন, তা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামোর গুণগত মানের ওপরও নির্ভরশীল। অথচ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মহাসড়ক নেই বললেই চলে। সড়ক-মহাসড়কের দিকে দৃষ্টি দিলে কর্তৃপক্ষের উপেক্ষা অবহেলা আরো প্রকটভাবে চোখে পড়বে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিতবাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-২০১৯শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক অবকাঠামোর মান বিবেচনায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল নেপালের তুলনায় এগিয়ে আছে। অথচ সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে সরকার। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। মানসম্পন্ন সড়কের অভাবে যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে উঠছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

দেশে মেগা প্রজেক্ট হোক, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা উন্নত হোক, তা সবারই কাম্য। তবে এসব প্রকল্প যথাযথভাবে নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই করার বিষয়টি কতটা নিশ্চিত করা হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নির্মাণাধীন সড়ক-মহাসড়ক কতটা টেকসই হবে, তার গ্যারান্টির কথা শোনা যায় না। এসব ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সড়কের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নির্দিষ্ট যৌক্তিক সময় বেঁধে দেয়া হলে তা যেমন টেকসই হবে, তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাট এবং অপচয়ও অনেক কমে আসবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্সের মাধ্যমে সরকারকেও জনগণের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে না। আমরা মনে করি, দেশে যেসব মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে, সেগুলো যথাযথ মানসম্পন্নভাবে হচ্ছে কিনা, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়মিত তদারক করা দরকার। কাজ হবে, মান ঠিক থাকবে না কিংবা যত বড় প্রজেক্ট তত বেশি দুর্নীতি অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

প্রকৌশলগত দুর্বলতার কারণে সড়কগুলোয় গর্ত ফাটলের পাশাপাশি গঠনবিন্যাসেও (অ্যালাইনমেন্ট) ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। সড়ক নির্মাণের আগে মাটিও পরীক্ষা করা হয় না। ফলে সড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। অনেকগুলো ধাপে সড়ক নির্মাণ করা হয়। সবার নিচে থাকে সাবগ্রেড। এরপর ইমপ্রুভ সাবগ্রেড। ইমপ্রুভ সাবগ্রেডের ওপর আনবাউন্ড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে আরেকটা গ্রেড তৈরি করা হয়। সেটার ওপর করা হয় বেজ কোর্স। এরপর দেয়া হয় পিচ ঢালাই। সড়কের গুরুত্বভেদে এসব ধাপ কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবগ্রেড নির্মাণে দুর্বলতা থাকলে আন্ডুলেশনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এটি অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা নাকি কাজে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা থেকে হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সওজের আওতাধীন জাতীয়, আঞ্চলিক জেলা সড়কগুলোয় নির্ধারিত সময়ের আগেই ফাটল বা গর্ত অথবা ঢেউ হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগার, যার মধ্যে সড়কে ব্যবহূত বিটুমিনের মানও একটি। তাছাড়া সড়ক টেকসই না হওয়ার আরো দুটি কারণের কথা বলছে সড়ক গবেষণাগার। সেগুলো হলো অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যান চলাচল এবং সড়কগুলোয় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে কমছে সড়কের স্থায়িত্ব। মহাসড়কগুলো জোড়াতালি দিয়ে কার্যকর রাখার চেষ্টা চলে এবং সেটিই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকসইভাবে এগুলো মেরামতের উদ্যোগ না থাকায় তাতে শুধু অর্থের অপচয় হয়। বলা চলে, সড়ক নির্মাণে পদে পদে অনিয়ম হচ্ছে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে নিম্নমানের ইট, খোয়া বিটুমিন ব্যবহার; ঠিকমতো মাটি বালি না ফেলা; সময়মতো কাজ শেষ না করে প্রকল্পের মেয়াদ ব্যয় বাড়ানো, দরপত্রের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ। এসব কাজে ঠিকাদার-প্রকৌশলীর যোগসাজশে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই আসছে। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণের ফলে বৃষ্টিপাত বন্যায় সড়ক দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। থেকে উত্তরণের জন্য কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। স্তরভিত্তিক কাজ তদারকি জোরদার করতে হবে।  সড়কের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, তা তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি জরুরি। স্পেসিফিকেশনের চেয়ে কম বিটুমিন ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ বা মেরামতে ক্রমাগতভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে, যা কাম্য নয়। প্রকল্পের কাজে দরপত্রে টেকনিক্যাল ফিন্যান্সিয়াল অফার মূল্যায়নে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি নির্মাণকাজে গাফিলতি ঠিকাদার নিয়োগে নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে পরিবহন চাহিদা বাড়ছে। এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে সড়কের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। একসময় নৌপথ রেলপথ ছিল দেশের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমান যুগের চাহিদা মেটাতে হলে সড়ক যোগাযোগ জোরদার করার পাশাপাশি নৌ রেলপথের উন্নয়নও আবশ্যক। সড়ক নির্মাণে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা আনতে হলে দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করতেই হবে। শুধু রাস্তা বানালেই গুড ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিস হয় না। ফাউন্ডেশনটাকে একেবারে নিচ থেকে তুলে নিয়ে আসাটাও গুড ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিস। নির্মাণের সময় সড়ক ভূমির ব্যবহার বিবেচনায় রাখা উচিত। এখানে আমাদের বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। মাটির রাস্তা বা চলাচলের স্থানে জেলা সড়ক নির্মাণ করতে হলে কতগুলো প্রকৌশলগত দিক মেনে চলতে হয় এবং সড়ক নির্মাণের আগে সেটি উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সড়ক-মহাসড়কের ক্ষেত্রেই নির্মাণকাজে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে প্রকৌশলগত দিকগুলো মানা হয় না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন