চলচ্চিত্রে গুরু-শিষ্যের পরম্পরা হারিয়ে যাচ্ছে?

রাইসা জান্নাত

জহির রায়হান থেকে চাষী নজরুল ইসলাম, কাজী হায়াৎবাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে রকম গুণী নির্মাতাদের নির্মাতা হয়ে ওঠার পেছনের গল্প একটু অন্য রকমই। তারা কেউ একদিনে নির্মাতা হয়ে ওঠেননি। নির্মাতা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় তারা নিজেদের যুক্ত করেছিলেন কোনো জ্যেষ্ঠ নির্মাতার অধীনে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালনে। অনেকটা গুরু-শিষ্য পরম্পরার মতো কাছ থেকে জ্যেষ্ঠ নির্মাতাদের কাজ দেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্যদিয়ে পুরোদস্তুর নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ তাদের। পরে তারা নির্মাণ করেছেন কালজয়ী সব চলচ্চিত্র।

১৯৫৭ সালে এজে কারদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাভেরায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের মধ্যদিয়ে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র অঙ্গনে পদার্পণ ঘটেছিল। ছবির পর জহির রায়হান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন নির্মাতা সালাউদ্দিনের যে নদী মরুপথে ছবিতে। এরপর ১৯৬১ সালে কখনো আসেনি নির্মাণের মধ্যদিয়ে তিনি পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

সময়েই চাষী নজরুল ইসলাম সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে তার যাত্রা করেন। তিনি ফতেহ লোহানীর আছিয়ায় সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। দুই বছর পর দুই দিগন্ততে কাজ করেন সাংবাদিক চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ-উল-হকের সহকারী হিসেবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর চাষী নজরুল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন নির্মাণ করে পুরোদস্তুর চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৭৪ সালে নির্মাতা মমতাজ আলীর সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কাজী হায়াৎ। এরপর চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সঙ্গে সীমানা পেরিয়ে ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে দ্য ফাদার নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার।

সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালক হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতা বর্তমানে কতটুকু চলমান নবীন চলচ্চিত্রকর্মীদের মাঝে? সংখ্যাটা কেমন? বিষয়টি নিয়ে জ্যেষ্ঠ পরিচালক এখনকার সহকারী পরিচালকরাইবা কী ভাবছেন?

সহকারী পরিচালক এবিএম নাজমুল হুদা, যিনি অন্তর্যাত্রা, মনপুরা গেরিলার মতো ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজে নির্মাতা হিসেবে এখনো কাজ শুরু না করলেও সহকারী পরিচালক থেকে কোনো নির্মাতা তৈরি হচ্ছেন না এটা মানতে নারাজ নাজমুল হুদা।

বর্তমানে সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালক হয়ে ওঠার উদাহরণ থাকলেও সংখ্যাটা নেহায়েত কম বলে মনে করেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এজন্য তারা দায়ী করছেন নানা সীমাবদ্ধতাকে, যার অন্যতম হচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র জগতের সামগ্রিক সংকট।

সহকারী পরিচালক থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠার পেছনের সংকট হিসেবে বাজেট, পরিচালকদের অনীহা, চলচ্চিত্র নির্মাণের সংকটের কথা বললেন নবীন নির্মাতা তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ। যিনি একসময় নিজেই সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে নির্মাতা হিসেবে কাজ করছেন।

মৌ বলেন, ‘সমস্যা হলো এখন চলচ্চিত্রের পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া বেশির ভাগ প্রডাকশনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বাজেট থাকে না। কাজেই একজন পেশাদার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত করতে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া প্রয়োজন, তা বেশির ভাগ প্রডাকশনই দিতে পারে না। তারা যতটা শ্রম সময় ব্যয় করেন, সে তুলনায় তাদের পারিশ্রমিক কম। অভিযোগটা আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়।

এদিকে সহকারী পরিচালক থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠার পেছনে পরিচালকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। তাদের অনেকের মতে, দেশে চলচ্চিত্র শিক্ষণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে এখনো ছেলেমেয়েরা পুরোপুরি তৈরি হয়ে বের হতে পারছেন না। বরং একজন পেশাদার নির্মাতার সঙ্গে যুক্ত হয়েই তারা কাজটা শিখতে পারছেন। কাজেই সহকারী পরিচালক হিসেবে যারা কাজ করছেন, নির্মাতা হয়ে ওঠার জন্য পরিচালকদের উচিত তাদের উৎসাহিত করা।

অনেকটা একই সুরে কথা বললেন মাটির প্রজার দেশে ছবির সহকারী পরিচালকরা। তাদের ভাষ্যে, ‘চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বড় সংকট হলো পেশাদারিত্বের অভাব। পরিচালকদেরও পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে।

বিভিন্ন প্রজেক্টের ওয়ার্কশপে জ্যেষ্ঠ নির্মাতারা উপস্থিত হন না বলে অভিযোগ তুললেন তারা। বললেন, ‘নির্মাতাদের ছাড় দেয়ার মনোভাবের কারণে প্রডাকশন হাউজগুলো অনেক কিছুর সুযোগ নেয় এবং চাপ প্রয়োগ করে। তারা যদি পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে কাজ করেন, তাহলে সহকারী পরিচালকদের সামনে কাজের একটা আউটলাইন থাকে। তারা বিভিন্ন জিনিস শিখতে পারেন।

তবে তাদের কথার সঙ্গে একমত নন দেশের জ্যেষ্ঠ নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। বিভিন্ন ওয়ার্কশপে সিনিয়র নির্মাতাদের অনুপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, ‘ওয়ার্কশপগুলোয় নির্মাতারা যান না, আমি তা মনে করি না। কারা আয়োজন করছে, তাদের উদ্দেশ্য কীএসব যাচাই-বাছাই করে তবেই একজন নির্মাতা ওয়ার্কশপে ক্লাস নিতে যান। কিছুক্ষেত্রে দেখা যায়, জ্যেষ্ঠ নির্মাতাদের নাম ব্যবহার করে ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে অনেকেই অনেক কাজ করেন। সেসব ওয়ার্কশপে নির্মাতারা যাবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

তবে সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালক হয়ে ওঠার পেছনে নির্মাতাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে একটু ভিন্ন কথা যুক্ত করলেন দেশের জ্যেষ্ঠ নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সহকারী পরিচালকদের নির্মাতা হয়ে ওঠার পেছনে জ্যেষ্ঠ নির্মাতাদের ভূমিকা মুখ্য নয়। একজন নির্মাতা যখন ছবির কাজ করেন, তখন তিনি নির্মাতা হিসেবেই কাজ করেন, প্রশিক্ষক হিসেবে নয়। তিনি তার সহকারীদের হাতে ধরে শেখাবেন না। বরং তিনি যেভাবে কাজ করছেন, যে কৌশল অবলম্বন করছেন, সেটা একজন সহকারীকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

বিশ্বব্যাপী সহকারী পরিচালক পদটির প্রচলন রয়েছে। সহকারী পরিচালক থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠার অনেক উপায় রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো অভিজ্ঞ নির্মাতাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করে তারপর নির্মাতা হওয়া। বাংলাদেশে রীতির প্রচলনই বেশি, বিশেষ করে এফডিসিকেন্দ্রিক নির্মাতাদের মধ্যে। প্রক্রিয়ার বাইরেও এমন অনেক নির্মাতা আছেন, যারা নিজস্ব জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়ে সরাসরি নির্মাতা হয়েছেন।

গুরু ধরে শেখার পদ্ধতি এফডিসিতে বেশি চর্চিত হলেও এখন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যেও এটি দেখা যাচ্ছে। যার উদাহরণ স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সহকারী পরিচালক থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠার পরম্পরাটি ধরে রেখেছেন ফারুকী। তার সঙ্গে একসময় সহকারী পরিচালকের কাজ করেছেন নির্মাতা রেদওয়ান রনি। পরে রেদওয়ান রনির সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন নিয়ামুল মুক্তা। মুক্তা সম্প্রতি কাঠবিড়ালী ছবির মাধ্যমে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

সে অর্থে নিয়ামুল মুক্তা হলেন তৃতীয় প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতা। সম্প্রতি কাঠবিড়ালী ছবির প্রচার-প্রচারণার সময়ও ফারুকী বিষয়ে বলেছেন, ‘নিয়ামুল মুক্তা আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের নির্মাতা। আমাদের দেশে ছবির সংখ্যা এখন কম। কাজেই তরুণরা যখন ছবি নির্মাণ করে, তখন আমাদের সবার উচিত তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো। ছবিগুলো দেখা অন্যকেও দেখতে উৎসাহিত করা। তাহলেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রি উঠে দাঁড়াবে। তা না হলে আমাদের শুধু অন্যদের ছবি দেখতে হবে।

সহকারী পরিচালক থেকে নির্মাতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠ নির্মাতাদের তরুণদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের অবকাঠামো নির্মাণ এবং চলচ্চিত্রের সংকট, বাজেটের অসংগতির মতো সমস্যাগুলো যদি সমাধান করা যায়, তাহলেই হয়তো দেশের চলচ্চিত্র ফিরে পাবে জহির রায়হান, চাষী নজরুল ইসলামদের সময়কার সেই গুরু-শিষ্যের পরম্পরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন