নির্মাণ ত্রুটিতে সড়ক মহাসড়কে ছোট ছোট ঢেউ

শামীম রাহমান

নওগাঁ-বদলগাছী-পত্নীতলা আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়নকাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের জুনে। এতে খরচ হয় ৬৫ কোটি টাকা। উন্নয়নকাজ শেষ হতে না হতেই জায়গায় জায়গায় দেবে যেতে শুরু করে মহাসড়কটি। কোথাও দেবে যাওয়া, আবার কোথাও স্বাভাবিক থাকায় সড়কের পিচটি হয়ে ওঠে ঢেউয়ের মতো, যাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয়আন্ডুলেশন

একই সমস্যা দেখা দিয়েছে পত্নীতলা-সাপাহার-রহনপুর আঞ্চলিক মহাসড়কও। ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মহাসড়কটিতে আন্ডুলেশন দেখা দেয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে যানবাহন চলাচল, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি সড়কের স্থায়িত্বও কমে যাচ্ছে।

শুধু এ দুটি সড়কই নয়, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের একটা বড় অংশের সড়কেই এ ধরনের সমস্যা রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিচের (পেভমেন্ট) মান যাচাইয়ের জন্যপেভমেন্ট ফেইলিউর ইনভেস্টিগেশন শিরোনামে একটি জরিপ চালিয়েছিল সওজ অধিদপ্তর। জরিপের নমুনায় ১৮টি সড়ক বেছে নেয়া হয়েছিল। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে এর প্রায় প্রত্যেকটিই আন্ডুলেশন সমস্যার মধ্যে রয়েছে।

সড়কের মানের ওপর ভিত্তি করে সেগুলোকে ভালো, চলনসই, দুর্বল, খারাপ ও খুব খারাপএই পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করে থাকে সওজ অধিদপ্তর। এর মধ্যে কোনো সড়কে যদি আন্ডুলেশন থাকে সেটি পড়ছেখারাপ সড়কের তালিকায়। আন্ডুলেশন থাকা সড়ক-মহাসড়ক ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে সেটি যেমন একদিকে যানজট ধীরগতির কারণ হয়, তেমনি পরোক্ষভাবে ভ্রমণ বা পরিবহন ব্যয়ও বাড়িয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের নির্মাণ ত্রুটিতেই আন্ডুলেশনের মতো সমস্যার উত্পত্তি। কখনো কখনো মাটির গঠন কাঠামোর কারণেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা। তবে সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর সিংহভাগ দায় চাপাচ্ছেন গাড়ির ওভারলোডিংয়ের ওপর। পাশাপাশি ব্যবহূত বিটুমিনের গুণগত মানের কারণেও নির্মিত সড়ক-মহাসড়কে আন্ডুলেশন দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

সড়ক-মহাসড়কে আন্ডুলেশন কেন হয়, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, অনেকগুলো ধাপে সড়ক নির্মাণ করা হয়। সবার নিচে থাকে সাবগ্রেড। এরপর ইমপ্রুভ সাবগ্রেড। ইমপ্রুভ সাবগ্রেডের ওপর আনবাউন্ড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে আরেকটা গ্রেড তৈরি করা হয়। সেটার ওপর করা হয় বেজ কোর্স। বেজ কোর্সের ওয়্যারিং কোর্স বা পিচ ঢালাই করা হয়। সড়কের গুরুত্বভেদে এসব ধাপ কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এর মধ্যে সবার নিচে যে ধাপটি থাকে, যেটাকে আমরা সাবগ্রেড বলি, সেটা নির্মাণে দুর্বলতা থাকলে আন্ডুলেশনের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ফরিদপুর, ঢাকা-সিলেট, সিরাজগঞ্জ-রাজশাহী জাতীয় মহাসড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কে আন্ডুলেশন সমস্যার কথা উঠে এসেছে সওজ অধিদপ্তরের পেভমেন্ট ফেইলিউর ইনভেস্টিগেশন প্রতিবেদনে।

ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কের ফরিদপুর-ভাঙ্গা অংশে প্রথম আন্ডুলেশন দেখা দেয় ২০০৮ সালে। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, বেড়েছে আন্ডুলেশনের পরিমাণ। তারপর কয়েক দফা সংস্কার ও উন্নয়ন হলেও মহাসড়কটির আন্ডুলেশন সমস্যাটি দূর করতে পারেননি সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা। একই সমস্যা রয়েছে বগুড়া-নাটোর জাতীয় মহাসড়কেও।

সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আন্ডুলেশন সড়কের পুরনো সমস্যাগুলোর একটি। এর প্রধান কারণ গাড়ির ওভারলোডিং। আমাদের সড়ক যে মানে তৈরি করা হয়, তার সঙ্গে গাড়ি চলাচলের নীতিমালা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে আমাদের সড়কগুলোর ভার ক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে গাড়ি চলছে। এ কারণেই আন্ডুলেশনের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। এক্সেল লোড নীতিমালা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সারা দেশে অনেকগুলো ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানোর কাজ চলছে। ওভারলোডিংটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমস্যাটি অনেকাংশে কমে যাবে।

ওভারলোডিংয়ের পাশাপাশি বিটুমিনও আন্ডুলেশনের জন্য কিছুটা দায়ী বলে মনে করেন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বলেন, আগে আমাদের ১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হতো। তবে আন্ডুলেশন, রাটিংয়ের মতো সমস্যা এড়াতে আমরা বর্তমানে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছি। পাশাপাশি বিটুমিনের মান উন্নয়নেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তবে ওভারলোডিংয়ের কারণে আন্ডুলেশন হচ্ছে, সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ওভারলোডিংয়ের কারণে রাটিংয়ের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিন্তু সেটি আন্ডুলেশনের জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়।

তার মতে, সড়ক-মহাসড়কে আন্ডুলেশন মেরামত করা না হলে সেটি দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বাড়িয়ে দেয়, তেমনি চলাচলরত গাড়িরও ক্ষতি করে। সড়কের পিচে উঁচু-নিচু ঢেউ থাকলে সেটি গাড়ি চলাচল বিঘ্নিত করে। আন্ডুলেশন থাকা সড়কের ওপর দিয়ে গাড়ি চলার সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হতে পারে, যা যাত্রাপথে যাত্রীদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। সড়কে আন্ডুলেশন দেখা দিলে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বেড়ে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন