চীন থেকে
দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে ভাইরাসটির
সংক্রমণের শিকার হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের দেয়া
তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছে অন্তত ৫৬ জন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি
জিনপিং। খবর রয়টার্স ও বিবিসি।
বিদ্যমান
পরিস্থিতিতে চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মা শিয়াওউই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নতুন এ ভাইরাসের বিষয়ে তাদের জ্ঞান ছিল খুবই সামান্য। তবে
ভাইরাসটির উন্মেষকাল সম্ভবত এক থেকে ১৪ দিন। এ উন্মেষকালেই এটি সংক্রমিত হয়, যা ২০০২-০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স (সেভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম) ভাইরাসের সংক্রমণ-লক্ষণ থেকে ভিন্ন। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া সার্সের
সংক্রমণে ওই সময় পুরো বিশ্বে মারা যায় প্রায় ৮০০ জন।
গত বছরের শেষ
দিকে মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে
নতুন এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই বাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করা হতো
বন্যপ্রাণী। প্রথমে বাজার, তারপর সেখান থেকে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বেইজিং, সাংহাইসহ বিভিন্ন শহরে। এরপর ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড,
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান,
অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স,
কানাডা ও নেপালে ভাইরাসটির
সংক্রমণের খবর আসে। এ পরিস্থিতিতে গতকাল দেশব্যাপী বাজার, রেস্তোরাঁ ও ই-কমার্স প্লাটফর্মে বন্যপ্রাণী বিক্রি নিষিদ্ধের
ঘোষণা দিয়েছে চীনা সরকার। কারণ প্রায়ই বন্য ও শিকার করা পশু একসঙ্গে রাখার কারণে
চীনের বাজারগুলো ভাইরাসের ‘ইনকিউবেটরের’ কাজ করে, যেখান থেকে ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, স্থানীয় বাজার ছাড়াও চীনা ই-কমার্স
প্লাটফর্ম আলিবাবা ও তাওবাওয়ে ময়ূর,
সাপ, কুমিরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী বিক্রি করা হয়।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শনিবার জরুরি অবস্থা জারি করেছে হংকং। একই সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন বাদ দেয়ার পাশাপাশি চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। গতকাল বন্ধ ছিল হংকংয়ের ডিজনিল্যান্ড ও থিম পার্ক। এছাড়া আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ডও। শনিবার হংকংয়ের নেতা ক্যারি লাম বলেন, শহরটিতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে পাঁচজন।
শনিবার কানাডায়
একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। কানাডিয়ান ওই নাগরিক চীনের উহান
থেকে দেশে ফিরেছেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় চার,
মালয়েশিয়ায় চার ও ফ্রান্সে
একজন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ।
ভাইরাসটি ছড়িয়ে
পড়া ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরগুলোয় বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে
চীনফেরত ব্যক্তিদের। কিন্তু এ ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ ফ্রান্সের প্যারিসের হাসপাতালে যে তিনজন চীনা নাগরিক
ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চিকিৎসাধীন,
তাদের মধ্যে দুজনের
প্যারিসে আসার সময় আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ ছিল না।
লন্ডনের
ইম্পেরিয়াল কলেজের সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞদের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান এ মহামারী যে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
সৃষ্টি করেছে তা স্পষ্ট। আর ভাইরাসটির সংক্রমণ চীনের মধ্যে রুখে দেয়া যাবে কিনা সে
বিষয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এরই মধ্যে উহানে
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে সব কর্মীকে বিশেষ উড়োজাহাজে করে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে
বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে অন্য যেসব মার্কিন নাগরিক চীনে এ ভাইরাসের সংক্রমণের
বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদেরও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হবে।
এদিকে বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)
এ সপ্তাহে বর্তমান
পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে গিয়েও করেনি। অথচ বেইজিংয়ের
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা লোকজনকে হ্যান্ডশেক করতেও নিষেধ করছেন। এ বিষয়ে নাগরিকদের
মোবাইল ফোনে পাঠানো হয়েছে ক্ষুদে বার্তা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হুবেই প্রদেশে
পাঠানো হয়েছে সেনাবাহিনীর বিশেষ মেডিকেল টিম।
তবে ভাইরাসটির
ছড়িয়ে পড়া, সংক্রমিতের সংখ্যা ও এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে
চীন স্বচ্ছতার দাবি করলেও সবাই তা মানছে না। কারণ এর আগে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার
সময় দেশটির সরকারের পদক্ষেপ খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। ফলে এবার উহান থেকে ছড়িয়ে
পড়া ভাইরাস নিয়েও কর্তৃপক্ষ সঠিক তথ্য দিচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
উহানের নাগরিকরা
বলছে, কর্তৃপক্ষ সংক্রমিত মানুষের সঠিক সংখ্যা জানাচ্ছে
না। আর ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে উহানে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা সন্তোষজনক নয়।
এদিকে চীনের
রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র পিপলস ডেইলিতে বলা হয়,
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ১
হাজার ৩০০ রোগীর জন্য দ্বিতীয় জরুরি হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হবে। এর আগে এক হাজার
ধারণক্ষমতার আরো একটি জরুরি হাসপাতালের নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।