দৈনিক বণিক বার্তায় ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি প্রকাশিত তিন পর্বের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অভিবাসনের জন্য ব্যবহূত পুঁজি পাচারকে আলোচনা-বিশ্লেষণের ফোকাসে নিয়ে আসা হয়েছে, যা প্রচুর তথ্যবহুল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের সুযোগ লাভের জন্য বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট অংকের অর্থ ওইসব দেশের আইন মোতাবেক বিনিয়োগের শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশের ধনাঢ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর জন্য এই অংকের অর্থ দেশ থেকে যেনতেনভাবে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার একটা অদম্য অনৈতিক প্রণোদনাকে আরো উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে এসব শর্তের মাধ্যমে। এই লোভনীয় টোপ প্রধানত ব্যাংকঋণ পাচার এবং আমদানি বাণিজ্যের বহুলব্যবহূত ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে ‘পুঁজির পলায়ন’ বা পাচারকে আরো উৎসাহিত করবে। অভিবাসনের জন্য পুঁজি পাচারের এই মহাযজ্ঞে দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, সামরিক অফিসার, প্রকৌশলী এবং বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের পরিবারের সদস্য-সদস্যা ও আত্মীয়স্বজনরাও ক্রমবর্ধমান অনুপাতে শামিল হয়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলছে আমার গবেষণায়। বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক-কর্মচারীর সিংহভাগ কর্তৃক ব্যবহূত রেমিট্যান্সের ‘হুন্ডি’ পদ্ধতি এসব গোষ্ঠীর পুঁজি পাচারকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে।
বণিক বার্তার প্রতিবেদনগুলোয় বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং গুটি কয়েক রাজনীতিবিদের পরিবারের সদস্যদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ নামগুলো প্রকৃতপক্ষে ‘হিমবাহের শৈলচূড়া’ বৈ তো নয়! দুর্নীতি দমন কমিশন যদি একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে অন্তত উল্লিখিত ছয়টি দেশের অনাবাসী বাংলাদেশীদের (এনআরবি) মধ্যে বহুল পরিচিত পুঁজি পাচারকারীদের বিস্তারিত একটি প্রোফাইল রচনার প্রয়াস নেয়, তাহলে সমস্যার ভয়াবহতার চিত্রটা ভালোভাবে ফুটে উঠবে (আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ রকম গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছি)। খেলাপি ব্যাংকঋণের ওপর পরিচালিত আমার নিজস্ব গবেষণায় আমি যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, তাতে আমার নিশ্চিত ধারণা হয়েছে যে খেলাপি ব্যাংকঋণের সিংহভাগই প্রকৃতপক্ষে বিদেশে ‘পলাতক পুঁজি’ হিসেবে পাচার হয়ে যাওয়ায় এসব খেলাপি ঋণের অর্থ আর কখনই ব্যাংকগুলো উদ্ধার করতে পারবে না। বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর গত এক বছরে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের একের পর এক যে অভূতপূর্ব ও অনৈতিক সুবিধা দিয়ে চলেছেন, তাতে টেকসই সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না, যদিও খেলাপি ঋণের পরিমাণের অতিসাময়িক হ্রাস এ সম্পর্কে একটা বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরতেও পারে। বরং আমার ভয় হচ্ছে, এ সুবিধাগুলো দেশের ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’দের জন্য ব্যাংক থেকে নতুন নতুন উপায়ে ঋণ বের করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। ব্যাংকের মালিকগোষ্ঠী ও পরিচালকরা এ সুযোগগুলো সৃষ্টিতে মদদ জোগালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অর্থমন্ত্রী কেন বুঝতে পারছেন না, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের অধিকাংশই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’, তাদের
ঋণ ফেরত দেয়ার পথে ফিরিয়ে আনা যাবে না? অতএব, তারা সরকারের সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নন। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাংকঋণের অর্থ বহু আগেই বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিদেশে তারা ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কিনে অভিবাসন নিয়ে ফেলেছেন। তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা বিদেশে বসবাস করছেন, তারা নিজেরাও মাসে-দুই মাসে বা আরো ঘন ঘন নিয়মিত রুটিন হিসেবে বিদেশে যাওয়া-আসা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ভান করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আদায় করার জন্য কখনো সরকার সত্যি সত্যিই জোর পদক্ষেপ নিলে তারা রাতারাতি দেশ থেকে চলে যাবেন।
দেশ থেকে প্রতি বছর কত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণালব্ধ অংক এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো অংকটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। তারা ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার (মানে তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ) বিদেশে পাচার হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি করেছে। এর আগে আইএমএফ ২০০৯ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বলেছিল। সম্প্রতি জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন আঙ্কটাড এই ৫ বিলিয়ন ডলারের অংকটাই আবার উল্লেখ করেছে। পুঁজি পাচারের পরিমাণ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান খুবই স্বাভাবিক, কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়াটি একটি গোপন প্রক্রিয়া হওয়ায় এর সঠিক চিত্রটি পাওয়া খুবই দুরূহ।
দেশে এখন প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং যেসব বিবেচনায় ২০০৯ সাল থেকে দফায় দফায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তাতে অর্থনীতির স্বার্থ কিংবা জনগণের আর্থিক লেনদেনের যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রয়োজনাতিরিক্ত জেনেও নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বজনপ্রীতির তাগিদে। পাঠকদের অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না যে এ দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সংকট যত গুরুতরই হোক, দেশের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে যাচ্ছে। অতএব, ব্যাংকের লাইসেন্স যারা বাগাতে পেরেছেন, তারা এ দেশে অতি সহজেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান ওই মুনাফার ভাগ পাওয়ার কারণে। সেজন্যই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্ল্যাসিক নজির হলো ব্যাংকের মালিকানা বণ্টনের এই রাজনৈতিক দুর্নীতি। আর এ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক কানেকশনের জোরে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেয়ে বিনা মূলধনে অন্য ব্যবসায়ীদের অর্থে তাদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক বনে গেছেন। মানে তার শেয়ারের জন্য বিনিয়োজিত পুঁজিও হয়তো ব্যাংকের অন্য পরিচালকরা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এ পরিচালকদের সিংহভাগ আবার দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যারা ব্যাংকের মালিকানা পেয়ে এ দেশের ব্যাংকঋণের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনে নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে তাদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও একে অন্যের ব্যাংক থেকে দেদার ঋণগ্রহণের সংস্কৃতি (লোন সোয়াপ) এ দেশে ভয়াবহ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। দেশের কয়েকজন রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী বিভিন্ন পন্থায় নানা নামে একাধিক ব্যাংকের বিপুল শেয়ার কিনে নেয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে নিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন সাতটি ব্যাংকের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন! ব্যাংকগুলোর ঋণ নিয়ে ওই ব্যবসায়ী নয়-ছয় করছেন বলে ব্যাংকারদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেনামি ঋণে নাকি সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। একজন ব্যক্তিকে এতগুলো ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতকে বড়সড় ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের ‘কমপিটিশন অ্যাক্ট’ তো এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা! ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এত সহজ সুযোগ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কিনা, আমার জানা নেই। আর্থিক খাতে ভবিষ্যতে ধস নামলে কিংবা ব্যাংকিং খাত কোনো মহলের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে অবাক হব না আমি।
ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনায় বারবার যে আশঙ্কাটি ব্যক্ত হচ্ছে তা হলো, বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। সম্প্রতি ২০ জানুয়ারি সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারেও স্বীকার করেছেন যে ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা সংকটজনক। এর মাঝেও সুখবর মিলেছে যে ২০১৯ সালে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ১৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী কর্তৃক ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফন ঘটেছে কিনা, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও এমন প্রণোদনা সঠিক নীতি-পরিবর্তন হিসেবে প্রশংসনীয়। কিন্তু এর ফলে হুন্ডি প্রক্রিয়া নিরুৎসাহিত হবে ধরে নিলে ভুল হবে। যতদিন ‘হুন্ডি ডলারের’ চাহিদা কাঠামোর রমরমা অবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে ততদিন ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোকে যতই উৎসাহিত করা হোক, সেগুলোকে নস্যাৎ করার জন্য ‘হুন্ডি ডলারের বিনিময় হার’ সমানুপাতিক হারে বাড়ানো হবে। অতএব, হুন্ডি প্রক্রিয়ায় ব্যাংকঋণ ও দুর্নীতিবাজদের দুর্বৃত্ত-পুঁজি পাচার এবং ওভার ইনভয়েসিং মোটেও দুর্বল হবে না। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ২ শতাংশ ঋণের অর্থ জমা দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের মধ্যে ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার যে প্রক্রিয়া অর্থমন্ত্রী চালু করে দিয়েছেন, সে সুবিধা ফেব্রুয়ারির পর আর না বাড়ানোই সমীচীন হবে। অর্থমন্ত্রীর এ পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশের ‘ব্যাংকিং জগতের বিবেক’ হিসেবে খ্যাতিমান ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের সুস্পষ্ট অভিমত, ‘অর্থমন্ত্রী
যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণ কমাতে চাইছেন, তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না। এভাবে খেলাপি ঋণ কমবে সাময়িকভাবে। দুই থেকে তিন বছর পরই সংকট বড় আকারে দেখা দেবে।’ ইব্রাহীম খালেদ মনে করেন, ‘যাদের
শাস্তির আওতায় আনা উচিত, উল্টো তাদেরকে ব্যাংক থেকে আরো টাকা বের করে নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।’ আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই, অর্থমন্ত্রীর এ ‘টোটকা দাওয়াই’ পুঁজি পাচারের পথে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাংকঋণ চিরতরে হারিয়ে যাওয়াকে আরো উৎসাহিত করবে।
ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়