পোলট্রি শিল্প

হ্যাচারির সংকট উত্তরণে করণীয়

এমএ কাদের

আমাদের দেশের ব্রয়লার লেয়ার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারির সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি। দেশে শুধু ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ২৩ লাখ পিস, যা দিয়ে মাংস উৎপাদন হচ্ছে প্রায় তিন হাজার টন। কিন্তু দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোয় তা যথেষ্ট নয়। কাজেই মুরগি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া বেকার সমস্যা দূরীকরণেরও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শিল্পে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

শিল্প ধ্বংস হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পোলট্রি মাংস নিয়ে অপপ্রচার, চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদন, উৎপাদিত মুরগির ভোক্তা না থাকা, বিদেশে রফতানি না করা, শুধু রান্নার মাংস হিসেবে ব্যবহার করা, উৎপাদিত মুরগির সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য না থাকা। তাছাড়া সঠিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী মুরগির বাচ্চা উৎপাদন না করা। বর্তমানে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন খরচ ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা হলেও প্রায় তিন বছর ধরে ( জুলাই ২০১৭ থেকে পর্যন্ত) ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে মাত্র থেকে ২০ টাকার মধ্যে। ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ১০৫ থেকে ১১০ টাকা হলেও দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। এই বিরাট লোকসানের প্রভাবে কিছু হ্যাচারি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। পোলট্রি মাংসের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কারণে মুরগির মাংস না খাওয়ায় গত ২০ বছরে উৎপাদিত বাচ্চার মূল্য বৃদ্ধি পায়নি, বরং আরো কমে এসেছে। কিন্তু গত ২০ বছরে মুরগির খাবার, মেডিসিন, ভ্যাকসিন যাবতীয় সরঞ্জামের মূল্য বেড়েছে পাঁচ-সাত গুণ। দেশে চাহিদা অনুযায়ী একদিনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে হ্যাচারিগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও বিদেশী অনেক কোম্পানিকে দেশে বাচ্চা উৎপাদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কারণে চাহিদার তুলনায় অধিক হারে বাচ্চা উৎপাদন হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন ধরে নিম্নদর থাকায় দেশে হ্যাচারিগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিক লোকসানের কারণে ব্যাংকঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এতে ঋণখেলাপি হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিসত্বর পরিকল্পিতভাবে সরকারের দৃষ্টিতে না এলে ছোট ছোট বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি খামার লোকসানের কারণে একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে হ্যাচারিতে লগ্নিকারী বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ে লোকসানে পড়বে এবং অনেক লোক বেকার হয়ে যাবে। তাছাড়া বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলো কৃষিভিত্তিক হলেও ব্যাংকঋণের লভ্যাংশ বিদ্যুৎ বিল নেয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক হারে।

প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের জন্য চাহিদামতো মুরগির মাংস খেলে প্রোটিনের অভাব পূরণের মাধ্যমে ইলেকট্রো কেমিক্যাল তৈরি হবে। ইলেকট্রো কেমিক্যাল তৈরি হলে নিউরো ট্রান্সমিটার সঠিকভাবে কাজ করবে। এতে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে এবং কাজের স্পৃহা বাড়বে। প্রোটিনের অভাবে সঠিকভাবে মস্তিষ্ক কাজ না করায় মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণেই দেশের মানুষ গরিব থেকে সহজে উত্তরণ হতে পারছে না। উন্নত দেশে সঠিক পরিমাণে মুরগির মাংস খাওয়ার কারণেই বুদ্ধিতে মানুষ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পোলট্রি মুরগির মাংস শুধু প্রোটিনের চাহিদাই পূরণ করে না। এটি পরিপূরক সুষম খাদ্য হিসেবেও কাজ করে। উন্নত বিশ্বে যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকায় বছরে একজন মানুষ গড়ে মাংস খায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। মালয়েশিয়ায় প্রতিজন বছরে মুরগির মাংস খাচ্ছে ৪০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে প্রতি জন মুরগির মাংস খায় মাত্র চার থেকে পাঁচ কেজি। উন্নত দেশের মানুষ আমাদের দেশের তুলনায় মুরগির মাংস খায় থেকে গুণ বেশি। ডিম খায় সাত থেকে আট গুণ বেশি। দেশে মুরগির মাংস এবং ডিমের চাহিদা এত কম থাকা সত্ত্বেও ভ্রান্ত নীতির কারণে এরই মধ্যে বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশে প্রবেশ করে পোলট্রি ধ্বংস করার জন্য জোরেশোরে ব্রয়লার বাচ্চা, ডিম কমার্শিয়াল মুরগি উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে থাইল্যান্ড কোম্পানির সিপি-বাংলাদেশ, চায়নার নিউহোপ, ইন্দোনেশিয়ার জাফপা এবং ভারতের সগুনা ভেনকিজ। বিদেশী এসব কোম্পানি অধিক হারে বাচ্চা উৎপাদনের কারণেই ব্রয়লার বাচ্চার দর দীর্ঘদিন ধরে আরো নিম্নমুখী। এই কঠিন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে (প্রাণিসম্পদ) অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত পোলট্রি শিল্পকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বিদেশী যেসব বড় মুরগির ফার্ম আমাদের দেশে জেঁকে বসেছে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে বাচ্চা উৎপাদন কমিয়ে রাখতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন রাখতে হবে অথবা উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে মিল রেখে মুরগির মাংস বিদেশে রফতানি করতে হবে। হ্যাচারির উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং উৎপাদিত মুরগি প্রতি কেজি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা করতে হবে। দেশের মানুষের মুরগির মাংস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে মুরগির মাংস সংযুক্ত করে দেশে-বিদেশে রফতানি করতে হবে। বিদেশ থেকে রোগাক্রান্ত, রোগ সৃষ্টিকারী গরু আমদানি বন্ধ করতে হবে (গরু-খাসির মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকায় ইদানীং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ছে) কারণে প্রচারের মাধ্যমে গরু-খাসির মাংস না খাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করতে হবে। যেসব মিডিয়া মুরগির মাংস না খাওয়ার জন্য অপপ্রচার চালায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

হ্যাচারিগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিনা লাভে অথবা কম লাভে ছোট ছোট হ্যাচারিকে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। মুরগি উৎপাদন কৃষিভিত্তিক বিধায় বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে কৃষিভিত্তিক করতে হবে। মুরগি বাচ্চা উৎপাদনের জন্য খাদ্য উপাদান, মেডিসিন ভ্যাকসিনের দাম কমাতে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হ্যাচারির (বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) আশপাশে কমপক্ষে এক কিলোমিটারের মধ্যে কেউ হাঁস-মুরগি, পাখিজাতীয় প্রাণী পালন করতে না পারে এর জন্য নিয়মনীতি থাকতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নত মানের ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। একদিনের উৎপাদিত মুরগির বাচ্চা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের জন্য ফেরিঘাটে সিরিয়াল ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোলট্রি শিল্পকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রফতানি করলে শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনেকাংশ বেকার সমস্যা দূর করাসহ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। কাজেই শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, এখনই সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। সুপরিকল্পিতভাবে পোলট্রি নীতি বাস্তবায়ন করে মৃতপ্রায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। এতে বেকার সমস্যা দূরসহ দেশের প্রোটিনের চাহিদা মিটবে এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।

 

এমএ কাদের: নিবন্ধকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন