রানা প্লাজা ধস

সুযোগ বুঝে সুবিধা নিয়েছে ক্রেতারা

বদরুল আলম

দেশে পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ শ্রম নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার চরম বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ২০১২ ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা গোটা পোশাক খাতের শ্রম নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে করে তোলে প্রশ্নবিদ্ধ। এই সুযোগে পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতারা কারখানা শ্রমসংক্রান্ত নানামুখী মানদণ্ড বা কমপ্লায়েন্স আরোপ করতে শুরু করে। ব্যবসা ধরে রাখতে পোশাক খাতের দেশী শিল্পোদ্যোক্তারাও কমপ্লায়েন্ট কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়তে মনোযোগ দেন। কিন্তু তার পরও দেখা যাচ্ছে, সুযোগ বুঝে নন-কমপ্লায়েন্সের অজুহাত তুলে সুবিধা নিয়েছে ক্রেতারা।

গত পাঁচ-ছয় বছরে ক্রেতা প্রতিনিধিরা একদিকে কারখানা শ্রম নিরাপত্তার মান উন্নয়নে পোশাক কারখানাগুলোর প্রতি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন একের পর এক, অন্যদিকে পণ্যের মূল্য কমিয়েছেন ক্রমাগতভাবে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের মূল বাজার যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ, পণ্যের মূল্য কমানোর প্রবণতা অব্যাহত ছিল দুই জায়গাতেই। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা পোশাকের ইউনিট মূল্য ছিল ডলার। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ক্রমহ্রাসমান ধারা অব্যাহত থাকলেও ২০১৮ সালে তা কিছুটা বাড়ে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা পোশাকের ইউনিট মূল্য দাঁড়ায় দশমিক ৭৯ ডলার। হিসাবে পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকের মূল্য কমেছে শতাংশ।

বিজিএমইএর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে ইউরোপের বাজারেও। ২০১৪ সালে ইউরোপে বাংলাদেশের রফতানি করা পোশাকের ইউনিট মূল্য (প্রতি ১০০ কেজি) ছিল হাজার ৫৭৩ দশমিক ২০ ডলার। ২০১৮ সালে তা নেমে আসে হাজার ৫১৫ দশমিক ৪৬ ডলারে। হিসাবে পাঁচ বছরে ইউরোপের বাজারে পোশাকের মূল্য কমেছে দশমিক ৬৭ শতাংশ।

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ শ্রম নিরাপত্তার দুর্বলতা চিহ্নিত দূর করতে জোটবদ্ধ হতে শুরু করেন ক্রেতা প্রতিনিধিরা। ইউরোপভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তৈরি হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি (অ্যাকর্ড) শীর্ষক জোট। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতা প্রতিনিধিদের জোট হয় অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি (অ্যালায়েন্স)

দুই জোটের ক্রেতা প্রতিনিধিদের শর্ত অনুযায়ী কারখানা শ্রম নিরাপত্তার মান উন্নত করতে কারখানা মালিকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, এজন্য কারখানাপ্রতি ন্যূনতম কোটি টাকা হিসাবে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে পোশাক শিল্পে বিনিয়োগকারীদের। অন্যদিকে প্রো-অ্যাকটিভ বা আগেভাগে সক্রিয় হওয়ার উদ্যম নিয়ে গ্রিন বা পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা স্থাপনে মনোযোগ দেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা।

পোশাক শিল্প মালিক প্রতিনিধিদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, মালিকদের তত্পরতার ফলে ২০১৪ সালে পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছিল তিনটি কারখানা। ধারাবাহিকতায় ৩৩টি স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে উঠেছে ২০১৯ সালে। প্রক্রিয়ায় আছে আরো ৫০০ কারখানা।

কমপ্লায়েন্স অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে শিল্পোদ্যোক্তারা মনোনিবেশ করলেও পোশাক পণ্যের ক্রেতারা সবসময়ই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আসছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি . রুবানা হক বলেন, এটা ঠিক। কিন্তু গত পাঁচ বছরে আমরা অনেক পথ অতিক্রম করেছি। এখন আমাদের গ্রিন বা পরিবেশবান্ধব শিল্পে অর্থায়নের মতো বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। 

বিজিএমইএ বলছে, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে উদ্যোক্তাদের। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পরও কারখানার পরিচালন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর পরও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ অব্যাহত আছে। কিন্তু পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে অর্থায়নের সুযোগের ঘাটতি দূর হয়নি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলতে পারলেও ক্ষুদ্র মাঝারি কারখানাগুলোকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আবার দুর্বল মানসিকতায় পণ্যের মূল্য নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে যথাযথ দরকষাকষিতেও পিছিয়ে পড়ছেন শিল্প মালিকরা।

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, গত পাঁচ বছরে পোশাক শিল্পের সবচেয়ে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল কমপ্লায়েন্স। বলতে গেলে এর ওপরই নির্ভর করেছে খাতের ভবিষ্যৎ। আর দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে প্রধান ক্রেতা দেশগুলো। কমপ্লায়েন্সের শর্ত জুড়ে দিয়ে খাতে নিজের যন্ত্রাংশের বড় বাজার সৃষ্টি করেছে ক্রেতা প্রতিনিধিরা। কারখানার অগ্নিনিরাপত্তাসহ সরঞ্জাম অন্যান্য যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে ইউরোপ-আমেরিকারই বেশকিছু প্রতিষ্ঠান।

এদিকে রফতানি আয়ে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি পোশাকের প্রধান ক্রেতা দেশগুলো কমপ্লায়েন্সের নামে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জার্মানি, ফ্রান্সসহ মোট ১০ দেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কাছে ফায়ার ডোর, হোস, এক্সটিংগুইশার, স্প্রিঙ্কলারসহ ভবন অগ্নিনিরাপত্তা যন্ত্রাংশ প্রদর্শন করেছে। ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স অ্যাকর্ডও এসব কমপ্লায়েন্ট যন্ত্রাংশ স্থাপনে নিজেদের পক্ষ থেকে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে।

বিষয়ে বিকেএমইএ প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সুদে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ঋণ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এর বাস্তব প্রতিফলন তেমন নেই। কারখানা কমপ্লায়েন্ট হোক, এটা এখন নিজস্ব তাগিদ থেকেই আমরা চাই। তবে এজন্য সংশ্লিষ্ট ক্রেতাদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। দুঃখজনক বিষয় হলো, কমপ্লায়েন্স দুর্বলতার সুযোগ নিতেই ক্রেতাদের ব্যস্ততা বেশি।

খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ক্রেতাদের অনুমোদিত সনদপ্রাপ্ত অধিকাংশ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের দাম অনেক বেশি। যেমন ইউএল স্ট্যান্ডার্ড ইকুইপমেন্টের দাম অন্যান্য যন্ত্রাংশের তুলনায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। অথচ অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহনের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনাই দেয় না ক্রেতারা।

তবে শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, রফতানি আয়ে অবদান বেশি রাখছে এমন দেশগুলো কর্মপরিবেশ শ্রম নিরাপত্তা নিয়ে বেশি সচেতন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কমপ্লায়েন্ট বা মানে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়গুলোয় উদ্যোক্তাদের দুর্বলতা থাকলে তা দূর করার চেষ্টাও দেশগুলোর তরফ থেকে বেশি হওয়ার কথা। পোশাকসহ টেকসই রফতানি খাত তৈরিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কমপ্লায়েন্ট কারখানা তৈরিতে আরো উদ্যোগী হতে হবে। আর তা শুধু একটি-দুটি দেশের জন্য নয়। বরং রফতানি বাজারের নিরাপদ বহুমুখীকরণের জন্য কমপ্লায়েন্ট ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারণ ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা কমপ্লায়েন্ট কর্মক্ষেত্র তৈরিতে উদ্যোক্তাদের দুর্বলতা প্রমাণ করেছে। আর সে সুযোগই নিতে শুরু করেছে ক্রেতা দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা।


পরিবেশবান্ধব কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের উদ্যোক্তা ফজলুল হক। নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা একটি খারাপ সময়ে পরিবেশবান্ধব গ্রিন কারখানা গড়ে তোলা শুরু করেছি। আমার একার কথা বলছি না। সবারই প্রত্যাশা ছিল বড়। কারখানাগুলো ব্যবসা একেবারে খারাপ করছে বলব না। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ বৈশ্বিক বাজারের শ্লথ গতি। সার্বিকভাবে বাজারের অবস্থা খারাপ থাকলে গ্রিন হোক আর যা- হোক, ব্যবসা ভালো হওয়ার কথা নয়।

পরিবেশবান্ধব গ্রিন কারখানায় বিনিয়োগের সময় ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের ভালো দাম পাওয়ার আশা করেছিলেন উদ্যোক্তারা। এসব কারখানা স্থাপনের পর এর স্বীকৃতি আদায়ে যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, রিটার্নটা অনুপাতে হচ্ছে না। তাই শুধু মুনাফার অংক বিবেচনায় নিয়ে যারা গ্রিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তাদের হতাশ হতে হয়েছে।

গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি সাধারণ কারখানা করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, গ্রিন কারখানায় তার চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি করতে হয়। অতিরিক্ত বিনিয়োগের রিটার্ন পেতে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তি ক্রয়াদেশ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ব্যাংকঋণের যৌক্তিক সুদের হার কর সুবিধাও প্রয়োজন পড়ে। এজন্য গ্রিন কারখানা স্থাপনের প্রবণতা ধরে রাখতে সরকারি প্রণোদনার বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন