করোনাভাইরাস

চীনের উহানে অবরুদ্ধ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন চীনের বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে হুবেই প্রদেশের উহান শহরের সঙ্গে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় সেখানকার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাসস্থানে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এর পরেও  চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এসব শিক্ষার্থীর কোনো খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে। যদিও বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চীনে মহামারী আকার ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১ জনে। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা শতাধিক। ভাইরাসের কারণে বিশেষ করে চীনের উহান প্রদেশের বাসিন্দারা এক ধরনের অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। প্রদেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় কোটি ১০ লাখ। সব মিলিয়ে উহানসহ প্রদেশের ১৬টি শহরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে চীন সরকার। সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে দেশটির ২৮টি প্রদেশে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে উহানের সঙ্গে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। শহরটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বসবাস করছেন পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশী। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এখন বাংলাদেশ দূতাবাসের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ছেন।

তাদের ভাষ্য, দূতাবাস থেকে শহরটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। যারা দেশে ফিরতে চাইছেন, তাদেরও ফেরার সুযোগ নেই। এখানকার বাজারগুলোও এখন বন্ধ। ফলে মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্যেরও সংকট দেখা দিয়েছে। শহরটিতে অবস্থানরত অভিবাসীদের জন্য খাবার সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত রাকিবিল তুর্য তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শহর উহানে আমি বাস করছি। এখানে আমরা ৫০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশী উহানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত। উহান থেকে বহির্গামী সব বাস-ট্রেন বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা চাইলেও এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছি না।

বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরকে ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি লেখেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয়া হয়নি। উহানে বসবাসরত সবাই এক কঠিন সময় পার করছেন।

অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়কে আশ্বস্ত করে বার্তা পাঠিয়েছে বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাস। মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, চীনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জরুরি সাহায্যের জন্য বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক লিন হুয়া বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন এবং সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। দূতাবাসও উহানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের পরামর্শ-সহায়তা দিচ্ছে। দূতাবাসের কূটনীতিকরাও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের চীন সরকারের নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন।

দূতাবাসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এটি সত্য নয়। আমাদের রাষ্ট্রদূত আমাকে জানিয়েছেন, তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং হটলাইন চালু করেছেন। সে হটলাইনের নম্বরও দেয়া হয়েছে। কারো যদি কোনো সাহায্য লাগে, তাহলে তারা যোগাযোগ করতে পারবেন। দূতাবাসের হটলাইন নম্বরটি হচ্ছে +(৮৬)-১৭৮০১১১৬০০৫।

সেখানে থাকা বাংলাদেশীদের জন্য কোনো নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে . কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমরা তো উদ্যোগ নিয়েছি। এখানকার বাংলাদেশীদের কেউ যদি ভাইরাস নিয়ে আসেন, তখন দেশে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। তারা যদি আসতে চান, নিজেদের ব্যবস্থাপনায় আসতে হবে। বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। 

সেখানে কোনো বাংলাদেশীর ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। সময় চীনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের উদ্দেশে আতঙ্কিত না হওয়ার বার্তা দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।

করোনাভাইরাস উপদ্রুত উহানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত হাবিবুর রহমান হাবিব নামে এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক পোস্টে জানান, সংক্রামক চিকিৎসার জন্য সব খরচ সরকার (চীন সরকার) বহন করছে। সরকার থেকে জানানো হয়েছে কারো যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেয়া যায়, তাহলে যেন তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে জানানো হয়। হুবেই প্রভিন্সের উহান সিটির এক বিশেষ জায়গায় আগামী ছয়দিনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একটা স্পেশালাইজড আন্ডারগ্রাউন্ড হসপিটাল, যেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বিশেষ চিকিৎসা দেয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চীনের প্রায় সব জায়গায় ফ্রি পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, চীনের হুবেই প্রভিন্সের ক্যাপিটাল সিটিসহ আটটি শহর সরকার থেকে লক করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ থাকবে সব ধরনের অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এমনকি সাবওয়ে, মেট্রো, পাবলিক বাসও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকার থেকে বলা হয়েছে. পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত যাতে কেউ শহর ত্যাগ না করে।

ভাইরাসটি প্রাণঘাতী হওয়ায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে চীন থেকে আসা যাত্রীদের ওপর নজরদারি বেড়েছে। বিভিন্ন এয়ারলাইনসকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বিমানবন্দরে কর্মরতদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, যাত্রী দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, বিমানবন্দরের স্যানিটেশন, ফিউমিগেশন আগত যাত্রীদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের শনাক্ত করতে বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে কেউ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত কিনা, তা শনাক্ত করতে রয়েছে তিনটি থার্মাল স্ক্যানার। শুধু চীন নয়, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড থেকে আসা কারোর মধ্যেও যদি জ্বর থাকে, তাহলে বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখছেন।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসএম আলমগীর প্রসঙ্গে বলেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আসতেও পারে। তবে তার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে চীনের উহান থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই। আমাদের বিমানবন্দরেও বিশেষ স্ক্রিনিং শুরু হয়েছে। বিভিন্ন এয়ারলাইনসকে আইইডিসিআর থেকে চিঠি দিয়ে সম্পর্কে জানানো হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন