গ্রামে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র

বিকশিত হচ্ছে শিশুরা কমছে দুর্ঘটনা

শামীম রাহমান

গ্রামীণ মায়েদের ব্যস্ততা, শহরের কর্মজীবী মানুষের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এক হাতে সংসারের সব কাজ সামলাতে গিয়ে অনেক সময়ই সন্তানের খেয়াল রাখতে পারেন না মা। আবার গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময়টিতে কখনো কখনো শিশুকে দেখাশোনার জন্য পরিবারের অন্য কাউকে পাওয়াও যায় না। সবার বেখেয়ালে শিশু হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ব্যস্ত রাস্তায় কিংবা পুকুর-জলাশয়ের ধারে। মুহূর্তেই ঘটে যায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। ফলে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করতে হয়ে কর্মব্যস্ত অনেক মায়ের।

কর্মব্যস্ত এমন মায়েদের নির্ভার রাখতে অরক্ষিত শিশুদের জন্য গ্রামে গ্রামে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)আঁচলনামে গড়ে তোলা হয়েছে এসব শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। এখানে শিশুরা বড় হচ্ছে ঠিক মায়ের আঁচলে থাকার মতোই।

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় সিআইপিআরবির শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বাস্তবায়ন পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা সিনারগোস। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে ৫৬৬টিআঁচলশিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে সংস্থাটি। এর বাইরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ শেরপুর সদর উপজেলাতেও রয়েছে একই ধরনের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর একদিনে মারা যায় ৪০ শিশু। তবে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দেখেশুনে রাখলে বছরে প্রায় নয় হাজার শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

গবেষণার তথ্য বলছে, সকাল ৭টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত পরিবারের কাজে ব্যস্ত থাকেন গ্রামের নারীরা। সময়ে শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামীণ শিশুদের সকাল ৭টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্তআঁচলমায়ের কাছে রাখা হয়। এখানে শিশুরা একসঙ্গে খেলে, নাচ-গান করে, গল্প বলে কবিতা আবৃত্তি করে।

শিশুদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকেনআঁচল মা তাকে সহযোগিতা করেন আরো একজন। সপ্তাহে ছয়দিন শিশুদের ছড়া, ছড়াগান, আবৃত্তি, গল্প বলা, ছবি আঁকা শেখান তারা। শেখানো হয় সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার বিষয়ও।

নরসিংদীর মনোহরদীতে উপজেলার গ্রামে গ্রামে এমন ৫৬৬টি আঁচল দিবাযত্ন কেন্দ্রগড়ে তুলেছে সিআইপিআরবি। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন দিবাযত্ন কেন্দ্র ঘুরে শিশুদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়েছে। সিআইপিআরবির উদ্যোগ সাদরে গ্রহণ করেছে গ্রামের সাধারণ মানুষও।

সিআইপিআরবির মনোহরদী উপজেলা কো-অর্ডিনেটর এএনএম মঈদুল ইসলাম জানান, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টিতে ৫৬৬টিআঁচলচালু করা হয়, যার মধ্যে বর্তমানে ৪৬১টি রয়েছে। কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ শিশু এবংআঁচল মানা পাওয়া। এসব দিবাযত্ন কেন্দ্রে নিরাপদে থাকা ছাড়াও শিশুরা পড়ালেখা সামাজিকতার বিষয়গুলো শিখছে। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে।

গত এক বছরে মনোহরদীতে সাতটি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাত শিশুর মধ্যে দুজনআঁচল দিবাযত্ন কেন্দ্রেআসত। তবে তারা দুর্ঘটনায় পড়েছে দিবাযত্ন কেন্দ্রের নির্ধারিত সময়ের পর।


আঁচল দিবাযত্ন কেন্দ্রেরকার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো শিশুদের সাঁতার শেখানো। সাঁতার শেখানোর জন্য বেছে নেয়া হয় দিবাযত্ন কেন্দ্রের আশপাশের কোনো পুকুরকে। পুকুরের বাঁশের বেড়া দিয়ে সাঁতারের স্থানটি সুরক্ষিত করা হয়। সেখানে চলে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে সাঁতারে সক্ষম শিশুদের অভিহিত করা হয়আঁচল গ্র্যাজুয়েটহিসেবে।

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার প্রতিরোধে কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল ড্রনিং রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ (আইডিআরসিবি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। দিবাযত্ন কেন্দ্রের উদ্যোগটি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আমিনুর রহমান জানান, তার মতেআঁচলদেশের কয়েকটি জেলায় কাজ করলেও সারা দেশের তুলনায় তা অনেক কম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রতি বছর দেশে যত শিশু মারা যায়, তার একটা বড় অংশই মারা যায় পানিতে ডুবে।

কিন্তু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের বিষয়ে আমাদের দেশে সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ে না। ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন