বহু কারণেই একটি যুগান্তকারী ঘটনায় পরিণত হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ৫০তম বার্ষিক সম্মেলন। বিশ্ব বাণিজ্য ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বহু আলোচ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে উঠেছে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনটি। যার মধ্যে চীন ও ভারতের উত্থান, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও পুনরুদ্ধার এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অন্যতম। চলতি বছর ক্রমবর্ধমান অন্তর্মুখী ও আঞ্চলিক প্রবণতা, সম্ভাব্য পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট, নতুন মুদ্রা ও নতুন হাতিয়ার হিসেবে ডাটার আবির্ভাব এবং এ প্রতিটি বিষয়েই রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে।
শুক্রবার শেষ হওয়া সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি ছিল জলবায়ু সংকট। একের পর এক অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে। নীতিনির্ধারকরা জলবায়ু সংকট নিয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিটের বৃহৎ ব্যাংকগুলোসহ আর্থিক খাত বিনিয়োগে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকি উপলব্ধি করছে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের চর্চা বদলানোর চাপ বোধ করছে।
জলবায়ু সংকট নিয়ে চলতি সম্মেলনেও গত বছরের ছায়া দেখা গেছে। কিশোর পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ু সংকট নিয়ে বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপের ঘাটতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে জলবায়ু পরির্তন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে তার প্রশাসনের অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানিউচিনের মন্তব্যে। জলবায়ু সংকট নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা বৃথা বলে মনে করেন মানিউচিন। তবে মানিউচিনের এ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছেন ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দে।
তার মতে আর্থিক বাজার ও অর্থনীতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংকট প্রশমিত করা যায়।
এদিকে গত তিন বছরে দাভোস সম্মেলনের সঙ্গে একটি অম্ল-মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামার চেয়ে বেশিবার দাভোস সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের বিশ্বায়নবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার অন্যতম মঞ্চ হয়ে উঠেছে দাভোস। সম্মেলনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নিজের অবদান তুলে ধরতে একের পর এক টুইট করে গেছেন তিনি। কর কর্তন ও বিনিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপের ফলে মার্কিন ব্যবসায়ীদের পছন্দের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প।
এবারের দাভোস সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতি খুব একটা নজরে আসেনি। সম্মেলনের শেষ পর্যন্ত কেবল অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভেদকেই যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা গেছে। দীর্ঘ জটিলতা শেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে যুক্তরাজ্য। ফলে সে প্রস্তুতি এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে দেশটির কাছে। তবে সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে ছিলেন লেবার পার্টির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড, সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ও সাবেক অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন অন্যতম।
সম্মেলনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি ছিল সাইবার নিরাপত্তা। সম্মেলনের প্রথম দিনেই ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজনের প্রধান জেফ বেজোসের হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়ার কথা প্রকাশ করে গার্ডিয়ান। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এর পেছনে জড়িত রয়েছেন। অধিবেশনে বলা হয়, গত বছর হ্যাকিং ঘটনার এক-চতুর্থাংশই ঘটিয়েছে জাতি-রাষ্ট্রগুলো। সাইবার হামলার বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছেন এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইউরি রাতাস।
চীন এবারের আলোচ্যসূচিতে থাকলেও গতবারের চেয়ে কম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের চীনের ‘দুই দেশ, এক নীতি’র প্রতি সমর্থন। শহরের স্থিতিশীলতার জন্যই এই নীতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডব্লিউইএফে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। ইন্ডিয়ান ওশেন রিমের ওপর অধিবেশনে গয়াল জানান, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আরো ন্যায্য ও যথাযথ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার পরিকল্পনা করছে নয়াদিল্লি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তিনি ইন্ডিয়ান ওশেন রিমের দেশগুলোর প্রতি বৃহত্তর সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
সূত্র:
গার্ডিয়ান, লাইভমিন্ট