এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ২০১০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়। ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। জটিলতার কারণে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে আবার নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। এসব কারণে ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। সে সময় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ১০০ ইভিএম তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে এসে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন আগের প্রযুক্তিটি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তির একটি ভোটিং মেশিন তৈরি করে, যার নাম দেয়া হয় ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম)। মেশিনটি তখন কমিশনের সামনে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তা করাও হয়। জানা যায়, নতুন এ পদ্ধতিতে শুধু আঙুলের ছাপ শনাক্ত হওয়ার পরেই ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। এটি জাল ভোট ঠেকানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন। বলা হয়, মেশিন ভেঙে ফেললেও বা পানিতে ডুবিয়ে দিলেও ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের হিসাব পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে কারিগরি ও প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ অনেক বিশেষজ্ঞকে ক্রমবর্ধিত হারে ভিন্ন মত প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে ইদানীং।
ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে। বিএনপি ইভিএমের বিপক্ষে। বিএনপির আশঙ্কা, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপি হবে।
ইসি বলছে, ক্রটিমুক্ত নির্বাচন করতেই ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে অনিয়ম ও কারচুপি কমবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ একেবারেই নেই তা নয়। তবে এটি হ্যাক করার সুযোগ নেই, সেই সঙ্গে প্রচলিত অনিয়ম, কারচুপির সুযোগও কম। ইভিএম বিষয়ে বিভিন্ন মহলে ক্রমবর্ধমান যে সংশয়, তা ইসিকেই দূর করার জন্য মাঠপর্যায়ে ব্যাপক হারে বাস্তবসম্মত ও হাতে-কলমে প্রণালি পদ্ধতি প্র্যাকটিসের আয়োজনের কাজগুলো সম্পাদন করতে হবে বলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করে।
ইভিএম বিষয়ে গভীরভাবে সন্দেহপ্রবণরা মনে করেন, দুটি জায়গায় ইভিএম এ ভোট কারচুপি করা সম্ভব। প্রথমত, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙুলের ছাপে ভোটারকে ভোট দেয়ার সুযোগ দিতে পারেন। এভাবে ২৫ শতাংশ ভোটারকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তা এ সুযোগ দিতে পারেন। তবে এ পরিস্থিতিতে কারচুপি হতে পারে। যদিও ইসির হালনাগাদ কথা হলো, এবার এ ক্ষমতা কমিয়ে ৫ শতাংশের মধ্যে আনা হবে। অন্যদিকে ভোটাধিকার প্রয়োগে উন্মুখ ভোটারদের বক্তব্য হলো, এটি অযাচিত অধিকার। ৫ শতাংশ দূরে থাক, শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ভোটারকে এ সুযোগ দেয়াও অনৈতিক মর্মে বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয় শঙ্কার বিষয় হলো, বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফল পরিবর্তন সম্ভব। কারণ ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। অর্থাৎ যন্ত্রে ভোট দেয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রিন্ট কপি ব্যালট জমা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কারচুপি হলে তা প্রমাণ করা যাবে না। তবে ইসি বলছে, এ ধরনের সন্দেহ থাকলে যে কেউ বিশেষজ্ঞ এনে ইভিএম পরীক্ষা করতে পারেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে পুরনো বাংলা দৈনিক পত্রিকায় ৮ জানুয়ারি ‘পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার নয়’—শিরোনামে প্রকাশিত খবরটির এক জায়গায় ইভিএম বিষয়ে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক
দলের আপত্তি সত্ত্বেও ঢাকার দুই সিটি ভোটে ইভিএম ব্যবহারে অনড় ইসি। ওই প্রকাশিত খবরের এক জায়গায় ইসি সচিবকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, কাগুজে ব্যালটের পরিবর্তে ইভিএম ব্যবহারে খরচ বেশি। কারণ এটা অনেক টেকনোলজি-সংশ্লিষ্ট। সেখানে নানা রকম প্রশিক্ষণ দিতে হয়। ইসি সচিব আরো বলেন, ইভিএমে কারিগরি ক্রটি দেখা দিলে প্রিসাইডিং অফিসার তা ঠিক করতে পারবেন না।’ ওই একই পত্রিকায় ‘ইভিএমের ব্যালট ইউনিট অরক্ষিত’ শিরোনামে (০৭/০১/২০২০) প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, ইভিএমে দুটি ইউনিট। একটি কন্ট্রোল ইউনিট, অন্যটি ব্যালট ইউনিট। এর মধ্যে ব্যালট ইউনিট অরক্ষিত। কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের পর ব্যালট ইউনিটে গিয়ে একজনের ভোট দিতে পারেন অন্যজন। কেননা কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারের ব্যবস্থা থাকলেও ব্যালট ইউনিটে তা নেই। ৬ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন উপলক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ইসি আয়োজিত ইভিএম প্রদর্শনীতে এ ক্রটি শনাক্ত করেন সাংবাদিকরা। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ওই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ইভিএম প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা যন্ত্রটির নানা খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন। এ সময় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীরা ইভিএম যন্ত্রে ডেমো ভোটে অংশ নেন। প্রদর্শনীতে সাংবাদিকরা ইসির প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে দেন ইভিএমে কীভাবে একজনের ভোট অন্যজন দিতে পারেন। দেখা গেছে, একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ইভিএম মেশিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। আর ব্যালটের মতো ভোটকক্ষে উপস্থিত থাকেন বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টরা। একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্মাটকার্ড বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দ্বারা কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটার শনাক্তের পর তাকে ভোটদানের জন্য বিবেচনা করা হয়। এ সময়ে ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার বা প্রভাবশালী প্রার্থীর এজেন্ট অনেক ক্ষেত্রে ব্যালট ইউনিটে পছন্দের প্রতীকে চাপ দিয়ে কনফার্ম বাটন চাপার সুযোগ পান। এ অবস্থায় আসল ভোটারকে ভোটদানের সুযোগ না পেয়ে ফিরে আসতে হয়।
প্রদর্শনীতে কর্মকর্তারা দাবি করেন, ইভিএম মেশিনে জাল ভোট দেয়া যায় না। তখন কয়েকজন সাংবাদিক কয়েকটি নির্বাচনের উদাহরণ টেনে প্রশ্ন করেন, ভোটারদের আঙুলের ছাপ নিয়ে ব্যালট ইউনিট সচল করার পর তাকে ভোট দিতে না দিয়ে অন্য কেউ ওই ভোট দিয়ে দিলে তা ঠেকানোর কোনো উপায় আছে কিনা?
এর জবাবে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক বলেন, বিষয়টি ঠেকানোর দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে ব্যালট ইউনিটে আঙুলের ছাপ নেয়ার পদ্ধতি নেই।
উল্লিখিত বিষয়ে একই পত্রিকায় ‘ইভিএমের ব্যালট ইউনিট সম্পূর্ণ সুরক্ষিত, ক্রটিমুক্ত দাবি ইসির’—শিরোনামে ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরটিতে ইভিএম ব্যালট ইউনিট সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও ক্রটিমুক্ত দাবি করেছে ইসি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, যদি কোনো ব্যক্তি ভোটকেন্দ্র বা গোপন কক্ষ দখল করেন, সেক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। এছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার বিধানও রয়েছে। ইসি সচিবালয়ের আইডিইএ প্রকল্পের অপারেশন প্ল্যানিং অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অফিসার ইনচার্জ স্কোয়াড্রন লিডার কাজী আশিকুজ্জামান স্বাক্ষরিত এর প্রতিবাদ লিপিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে ব্যালট ইউনিটে ফিঙ্গার সংযুক্তির ব্যাপারে কমিশন থেকে কিছুই বলা হয়নি।
সেই প্রেক্ষাপটে কমবেশি ১১ কোটি ভোটারসমৃদ্ধ বাংলাদেশে ইভিএম নিয়ে সময়, অর্থ, কূটতর্ক, অতি উৎসাহ, বাদানুবাদ, হুমকি-ধমকি ইত্যাদি পরিহার করে সামনের সংসদ নির্বাচন ইভিএম ব্যবহার বাদ দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃজনে মনোযোগী হবে, দেশবাসীর তা-ই প্রত্যাশা। দাওয়াত দিয়ে সমস্যা ডেকে আনার দরকার কী? আর সময়ই বা কোথায়?
শেষ কথা, ব্যালট পেপারে ভোটদানে মাত্র এক ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। আর ইভিএমে ভোট দিতে কমপক্ষে ১৮ রকমের টেকনিক্যাল সমস্যা নিরসনের পর ভোটদান করা সম্ভব হয়। সরল পরিহার করে গরলে ডুব দেয়া কি ভালো লক্ষণ?
কারার মাহমুদুল হাসান: সাবেক সচিব