নতুন নামে ও রূপে এমএলএম ব্যবসা

আর্থিক প্রতারণা বন্ধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক

বহুধাপ বিপণন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। হায় হায় কোম্পানিগুলো মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করেছে আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত প্রযোজ্য সরকারি লাইসেন্স ছাড়াই। পরবর্তী সময়ে সরকার এমএলএম কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন পাস করে। এতে বলা হয়, লাইসেন্স ছাড়া বহুধাপ বিপণন কার্যক্রম চালানো যাবে না; যেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম রয়েছে, আইনটি পাসের পর ৯০ দিনের মধ্যে তাদের লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া কেউ কার্যক্রম চালালে তার ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ৫০ লাখ টাকা জরিমানা হবে। আইন পাসের পরও নতুন নতুন নামে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছে অনেকে। এতে প্রতারিত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে এমএলএম কোম্পানিগুলো বিপুলসংখ্যক মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। রকম দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম এখনো অনেক মানুষ ভুলতে পারে না, যেমনআইটিসিএলযুবক সর্বসম্প্রতি ডেসটিনি গ্রুপের এমএলএম কার্যক্রম আরো বেশিসংখ্যক মানুষের বিপুল অংকের অর্থ লোপাট করে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অবশেষে আইনানুগ পদক্ষেপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু লাখ লাখ মানুষ যে আর্থিক ক্ষতি হতাশার শিকার হয়েছেন, তার প্রতিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি এই গণপ্রতারণার সুযোগ পেয়েছে প্রধানত পূর্বাপর সরকারের নজরদারির অভাবে।

প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা, সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশ ব্যাংকের হুঁশিয়ারি কোনো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না মাল্টিপারপাসের (এমএলএম) নামে প্রতারণা। রীতিমতো আইন পাস করেও প্রতারণামূলক বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বরং নগর-মহানগর ছাড়িয়ে গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটছে এমএলএমের। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে অতিলাভের লোভ দেখিয়ে জামানত বাবদ লাখ লাখ টাকা জমা নিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে সংস্থাগুলো। হায় হায় কোম্পানিতে পরিণত হওয়া এসব সংস্থা লাখ লাখ দরিদ্র মানুষকে রাতারাতি পথে বসিয়ে ছাড়ছে। এমএলএম প্রতিষ্ঠানের গালভরা লাভের বুলির কাছে আটকা পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। দুঃখের বিষয়, যারা প্রতারণার শিকার হচ্ছে, তাদের নালিশ করার জায়গা পর্যন্ত জানা নেই। পয়েন্ট বিক্রির প্রতিযোগিতায় টার্গেট ফিল করতে পারে না অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ খোলাখুলি বলেছে যে ধরনের প্রতারণামূলক কাজে নিয়োজিত কোনো একটি কোম্পানির হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা দুদক কর্তৃক অবৈধ করা হলেই তারা অন্য নামে ভিন্ন এলাকায় আবার কার্যক্রম শুরু করে। অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে টাকা একবার বেহাত হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। অতএব, জনগণের অজ্ঞতা সরলতাকে পুঁজি করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন তাদের কষ্টার্জিত টাকা আত্মসাৎ করতে না পারে, সেজন্য সরকারের শক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

এমএলএম ব্যবসা দেশের সব এলাকায়ই ছোট আকারে প্রায়ই গজিয়ে ওঠে এবং অর্থ নিয়ে মতভেদের ফলে ঝরে যায়। জাতীয় পর্যায়ের খবরে এগুলো অনেক সময় আসে না। কিন্তু প্রতারকদের হাতে যখন বহুসংখ্যক মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে, তখনই কেবল এটি পত্রিকায় ছাপা হয় এবং নিয়ন্ত্রকদের নজরে আসে। এমএলএম ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা না রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকবারই পত্রপত্রিকা টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেমিনার করে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এভাবে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা যায়নি। তালিকাভুক্ত ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারে না, কথাটি বুঝতে পারা খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ অতিমুনাফার লোভে পড়ে এদের কাছে টাকা জমা দেয় এবং প্রতারিত হয়। এমএলএম ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা রেখে দেশে অনেক লোক নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সরকার একাধিকবার কমিশন বানিয়েও যুবক, ডেসটিনির টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিতে পারেনি। এমএলএমের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে হলে সরকারকে যেমন আইন প্রণয়ন করে কঠোরভাবে তা কার্যকর করতে হবে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের অধিকতর সচেতন থাকতে হবে। আজকাল অর্থনৈতিক টানাপড়েনে পড়ে বা দুর্নীতির কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দু-একটি ব্যাংক কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকেও বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তালিকাভুক্তদেরই যখন এরূপ অবস্থা, তখন টাকা আত্মসাৎ করার ইচ্ছা নিয়েই জন্ম নেয়া এমএলএম কোম্পানিগুলোর অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

প্রতারকদের খপ্পর থেকে রক্ষা পেতে কেবল সরকারি আইনই যথেষ্ট নয়, বিষয়ে সবাইকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশে আর্থিক বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা জ্ঞানের অভাব রয়েছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও। কোন খাতে, কীভাবে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে, মুনাফা অর্জনের বিষয়টি কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং টেকসই, কোথায় অর্থ বিনিয়োগে ঝুঁকি কমএক্ষেত্রে নিজেকে কী কী বিষয় বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা লাভ না করেই এখানে যে কেউ হুট করে শেয়ার ব্যবসায় কিংবা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি, কো-অপারেটিভ সোসাইটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। নির্বোধের মতো নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতারিত হচ্ছেন, ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সর্বস্বান্ত, নিঃস্ব, রিক্ত হচ্ছেন। সব হারিয়ে পরে আক্ষেপ করে কোনো ফায়দা নেই। যেকোনো বিনিয়োগে আগে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে, নিজের বুদ্ধি বিবেচনাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন