বটপাতায় লেখা নিমন্ত্রণপত্র, সম্বোধনে আঞ্চলিক ভাষা

বণিক বার্তা অনলাইন

বিয়ের নিমন্ত্রণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেয়াই গ্রাম বাংলার রীতি। সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনদের সশরীরে গিয়ে নিমন্ত্রণ করা হতো। তবে শিক্ষিত মানুষেরা পত্রবাহক পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করার সুযোগ নিয়েছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, কাগজ আবিষ্কারের আগে গাছের পাতা, বাকল, পশুর চামড়া, মাটি ও পাথরের ফলক, ধাতব পাতে লিখতো। ধারণা করা হয়, বিশেষ করে চিঠি বা বার্তা গাছের পাতায় লেখা হতো বলেই এর নাম হয়েছিল ‘পত্র’। ঊনিশ শতক থেকে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চিঠি চালাচালির সংস্কৃতি চালু হয়ে যায়। বিবাহ কিংবা শিশুর মুখে ভাতের মতো অনুষ্ঠানে জাঁকজমক করে নিমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়। এ সংস্কৃতি এখনো চালু আছে।

অবশ্য প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে যোগাযোগের ধরন। চিরাচরিত রীতিগুলোতেও ছেদ পড়েছে অনেক। আগেকার সেই নিমন্ত্রণের রীতি এখন শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান আর অফিস আদালতের কিছু দাপ্তরিক কাজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পরিবর্তে এসেছে ফোনকল, এসএমএস, ই-মেইল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াতের প্রচলন। অনেকে মেসেঞ্জারে ডিজিটাল কার্ডও পাঠান।

এদিক থেকে ব্যতিক্রম রংপুরের শতবর্ষী কারমাইকেল কলেজের একটি সংগঠন ‘বিতর্ক পরিষদ’। মাঝে মধ্যেই তারা বিভিন্ন আয়োজনে বটপাতায় লেখা নিমন্ত্রণপত্র পাঠায়। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সংগঠনটি সাপ্তাহিক অনুশীলনে বিতর্কের পাশাপাশি শুদ্ধ উচ্চারণ, কবিতা আবৃত্তি, সাধারণ জ্ঞান, উপস্থাপনা প্রভৃতি চর্চা করে আসছে। চর্চার ফলও পেয়েছে সংগঠনের সদস্যরা। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বিতর্কে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ারও কৃতিত্ব রয়েছে এই সংগঠনের সদস্যদের।

সংগঠনটির শিক্ষক উপদেষ্টা বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, গাছের সবুজ পাতায় লিখে নিমন্ত্রণ করার ধারণাটা একেবারে নতুন তা বলবো না। আগেও কারমাইকেল কলেজের সংগঠনগুলো থেকে এরকম নিমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছে, বাংলা বিভাগ থেকেও কয়েকবছর আগে পহেলা বৈশাখে এ ধরনের নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল। তবে চড়ুইভাতি উপলক্ষে বিতর্ক পরিষদের পুরনো রীতিতে চিঠি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। 

তিনি বলেন, এই নিমন্ত্রণপত্রটা দেখে আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়েও বেশ চমৎকৃত হয়েছে। বেশ কয়েকবার নাড়াচাড়া করে দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো- চিঠিটা এমন কেন? ইন্টারনেট যুগের এ প্রজন্মকে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য হলেও এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি।

‘চড়ুইভাতি’ উপলক্ষে করা নিমন্ত্রণপত্রটির কার্যসূচিতে ‘গেরামের খ্যালাধুলা’ ‘খাওন দাওন’, ‘ভাগ্য পরিখ্যা’ ইত্যাদি আঞ্চলিক শব্দসহ পুরো নিমন্ত্রণপত্রটি লেখা হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায়। এই নিমন্ত্রণপত্রের বিষয়ে কথা হয় সংগঠনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এসএম শামীমের সঙ্গে। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন এই কলেজটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার একটা ভালো প্লাটফর্ম রয়েছে। এখানে বিতর্ক পরিষদ ছাড়াও বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনগুলো জাতীয় ও বিশেষ বিশেষ দিবস ছাড়াও বাৎসরিক বনভোজন, ইফতার পার্টিসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসবে অংশ নেয়। এসব অনুষ্ঠানে চেষ্টা থাকে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের চড়ুইভাতি অনুষ্ঠানে আমরা এ ধরনের নিমন্ত্রণপত্র করেছি। 

সম্বোধনে ‘বাহে দেওয়ানির ব্যাটা বা বেটি’ লেখা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রংপুর অঞ্চলের সম্মানিত ব্যক্তিদের এভাবে সম্বোধন করা হতো। শুধু তাই নয় নিমন্ত্রণপত্রে শিক্ষকদেরও সম্বোধন করা হয়েছে ‘মাস্টর সাব’। অন্যদের ভাইজান, বুবুজান, দোস্ত, সাগাই বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন