পোশাক খাত

ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরে উন্নতিতে করণীয়

মো. আকতারুল ইসলাম

নিলু, কাজ করেন সাভারে নামকরা একটি পোশাক কারখানায়। সারা মাস কাজ করে যে বেতন পান, নিজের হাতখরচ রেখে তুলে দেন মা-বাবার হাতে। পোশাক খাতে কাজ করে নিলু নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। নিজের দরকারে টাকা খরচ করতে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। মা-বাবাকে দেখাশোনা করতে পারেন। পোশাক খাত তাদের জীবন বাঁচিয়েছে। নিলু আগামীতে সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। লাখো নিলু পোশাক খাতে কাজ করে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন ভালো প্রজন্মের, সুখী-সমৃদ্ধ পরিবার ও সমাজের। তবে পোশাক শিল্পের ভেতর-বাইরের গুটি কয়েক যৌন হয়রানির অভিযোগ অনেক নিলুর স্বপ্নকে ডানা মেলতে বাধা দেয়।

কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মহামান্য হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ১৪ মে নির্দেশনামূলক একটি নীতিমালা প্রদান করেন। এতে যৌন হয়রানি বলতে যা বোঝায়অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ, প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারো সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা, চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিস, কার্টুন, বেঞ্চ-চেয়ার, টেবিল, নোটিস বোর্ড, অফিস, কারখানা, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা। ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে স্থিরচিত্র বা ভিডিও ধারণ করা। যৌন হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া বা চাপ প্রয়োগ করা। ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা বা স্থাপনের চেষ্টা করা। এসব আচরণ নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং অপমানজনক।

নিলুর সংকোচহীন কথা, ‘গার্মেন্টে কাজ করি বইল্যা রাস্তা দিয়া চলাফেরার নিরাপত্তা নাই। বেডারা খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়। পোশাক শিল্পে একটি অভিযোগ প্রচলিতপান থেকে চুন খসলেই কর্মীদের শুনতে হয় অকথ্য ও অশ্লীল গালিগালাজ। পোশাক কারখানার যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রথম তীর লাইনম্যান, সুপারভাইজার, সহকারী প্রডাকশন ম্যানেজার-এপিএম, ম্যানেজারসহ কারখানার মাঝারি পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তবে নারী শ্রমিকরা কমবেশি পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছর কয়েকটি এনজিওর করা গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক কারখানায় ১৪ শতাংশ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা যে ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হন, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ হচ্ছে কামনার দৃষ্টিতে তাকানো, সংবেদনশীল অঙ্গে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ, কাজ বোঝানো বা কথা বলার সময় হাত-পা, শরীর স্পর্শ করে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে খারাপ ভাষায় গালি দেয়া, চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদোন্নতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ হার আগের তুলনায় অনেক কম। গত ১০ বছরে যৌন হয়রানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কর্মপরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। মালিক-শ্রমিক এখন অনেক সচেতন। বেসরকারি গবেষণাসেফটি অ্যান্ড রাইটস’-এর করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি পান। ৯৬ শতাংশ অসুস্থতাজনিত ছুটি, ৮০ শতাংশ বার্ষিক ছুটি, ৮২ শতাংশ মাতৃত্বকালীন ছুটি, এমনকি ৬৯ শতাংশ শ্রমিক অর্জিত ছুটিও ভোগ করতে পারছেন। পোশাক খাতে বিদ্যমান এসব সমস্যা মোকাবেলা করেই লাখ লাখ নারী শ্রমিক আজ স্বাবলম্বী। নারীর অভিগম্যতার ফলে নিজে আজ কথা বলতে পারেন, নিজের অর্থ নিজে ব্যয় করতে পারছেন, দলবেঁধে রাস্তায় হেঁটে কারখানায় কাজে যেতে পারছেন।

কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কারখানা মালিকদের সহযোগিতায় প্রতিটি কারখানায় সেফটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। পাঁচ হাজারের বেশি কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন এবং শ্রমিকদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গার্মেন্ট শ্রমিকদের যেকোনো সমস্যায় ২৪ ঘণ্টা টোল ফ্রি (১৬৩৫৭) হেলপ লাইন চালু করেছে। এ হেলপ লাইনে কল করে সমস্যার কথা বললে অধিদপ্তর শ্রম পরিদর্শকের মাধ্যমে অভিযুক্ত কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠু সমাধান করে দিচ্ছেন। যেকোনো নারী শ্রমিক বিনা পয়সায় মোবাইল থেকে কল করে যৌন হয়রানিসহ যেকোনো অভিযোগ দিলে এর সুষ্ঠু সমাধান করার ব্যবস্থা করা হবে। এ টোল ফ্রি হেলপ লাইনে যেকোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে তার চাকরি হারানো বা আর কোনো হয়রানির ভয় নেই। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির অভিযোগ কারখানা মালিকের কাছে এলে অপরাধ বিবেচনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া, নারী শ্রমিকদের মধ্যরাত পর্যন্ত ওভারটাইম না করানো, চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে কাউকে বলবেন নানারী শ্রমিকদের এ ধারণা থেকে বের হতে হবে। 

এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও বৈষম্য প্রতিরোধের জন্য একটি কর্মকৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। নারী কর্মীরা যাতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করতে পারেন, সে লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় প্রায় দুই হাজার নারী শ্রমিকের আবাসন সুবিধাসম্পন্ন মহিলা হোস্টেল নির্মাণ করা হচ্ছে। কারখানার কাছাকাছি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব জমিতে পর্যায়ক্রমে আরো এ ধরনের হোস্টেল নির্মাণ করা হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নারী কর্মীদের কারখানায় যাওয়া-আসার সময়ে রাস্তায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কারখানাভিত্তিক হোস্টেল নির্মাণ সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ বিশ্বে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে রোল মডেল। সরকার-মালিক সবাই কর্মপরিবেশের আরো উন্নয়নে আন্তরিক। পোশাক কারখানা এলাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে শিল্প পুলিশের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে।

দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি পোশাক আজ এ অবস্থায় এসেছে লাখো নারী কর্মীর শ্রম আর ঘামে। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য বিশাল অর্জন। গত কয়েক বছরে পোশাক কারখানাগুলো অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তদারকিতে সংস্কার কার্যক্রম ব্যয়, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতি, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের নানা প্রকার শর্তারোপ, ক্রেতাদের পোশাকের দাম না বাড়ানো এবং গত ১০ মাসে পোশাক পণ্য রফতানিতে এ শিল্প কিছুটা চাপের মুখে।

নিলুর মতো লাখো নারী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সরকারের পাশাপাশি মালিক-শ্রমিক সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বায়ারদের কাছে মূল্যবৃদ্ধির দাবি আরো জোরালো করা যাবে। পিএম, এপিএম, সুপারভাইজারসহ কারখানার মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সব পর্যায়ের কর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। শেষ কথা, যৌন হয়রানির অভিযোগ থেকে ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরের উন্নতি পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নেবে আরো এক ধাপ।

 

মো. আকতারুল ইসলাম: তথ্য কর্মকর্তা

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন