হাকালুকি হাওড়ে বিলীন হয়ে পড়ছে বিল

ভরাট ও দখল-দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক

প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি হাওড়। প্রকৃতি প্রদত্ত হাওড়ের ভূগঠন এমনই যে, পানি সরিয়ে ফেলাও সম্ভব নয়। এ পানি আমাদের সম্পদ। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা ও সম্পদের উৎস। এর সঠিক ব্যবহার আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। এরই মধ্যে খবর মিলছে, হাওড়গুলোর অবস্থা সঙ্গিন। এশিয়ার অন্যতম হাকালুকি হাওড় ক্রমেই ভরাট হতে হতে এখন শুকনো মাঠের আকার ধারণ করেছে বেশকিছু বিল। উপকূলীয় এলাকা সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে মনোযোগ ও গুরুত্ব পেয়েছে, হাওড় সে তুলনায় কিছুই নয়। অথচ সম্পদ, সম্ভাবনা ও সমস্যা হাওড় এলাকায় কম নয়। দুর্বলতা হচ্ছে, এর গুরুত্ব যত্নসহকারে উপস্থাপনে ব্যর্থতা। সঠিক প্রচার ও নজরের অভাবে এগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। জলের মাঝে জলকেলি খেলে আয়-রোজগারের উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হয়নি। হাওড়ের মিঠাপানিকে নিজেদের মতো ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে এর উপকারিতা। বাস্তবানুগ পরিকল্পনার মাধ্যমে হাওড়ের পানি মানুষের জন্য সারা বছর আয়বর্ধক কর্মসংস্থানের স্থায়ী ক্ষেত্রে পরিণত করার কর্মপরিকল্পনার কথা আমাদের ভাবতে হবে। দখল ও দূষণ রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত।

বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালেজলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করে। এজলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি আসলে দেশের ভেতরে অবস্থিত ২০ একরের কম এবং ২০ একরের অধিক বদ্ধ জলমহালগুলো লিজ দেয়ার নীতি। নীতির ২৯ ধারায় জলাশয়গুলোতে অভয়াশ্রম ও মা-মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা বলা আছে। ২৯ ধারায় মত্স্যজীবীদের টোকেন ফি দিয়ে মাছ ধরার লাইসেন্স দেয়ার কথাও বলা আছে। কিন্তু এ নীতির অপব্যবহার করে হাওড়সহ সারা দেশেরখোলা জলমহালগুলোকেবদ্ধ জলমহাল হিসেবে দেখিয়ে লিজ দেয়ার অবৈধ প্রক্রিয়া চলছে, যাতে হাওড়গুলো লিজ গ্রহণকারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এমনখোলা জলমহাল বাভাসান পানিকে বদ্ধ জলমহাল হিসেবে দেখানোর বিরুদ্ধে হাওড়ের মানুষদের প্রতিরোধভাসান পানি আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ আছে, লিজ গ্রহণকারীরা বর্ষাকালে এলাকাটি নদীর পানিতে প্লাবিত হলে সারা এলাকায় জেলেদের মাছ ধরতে বাধা দেয়। হাওড়গুলো মূলত খোলা জলমহাল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে মাছদের হাওড়ে বন্দি করে রাখায় তারা বেরোতে পারছে না, ডিম ছাড়তে পারছে না। এভাবে তাদের প্রজনন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই হাওড়গুলোতে মাছও কম। হালদা নদীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মত্স্য প্রজননকালীন সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এ সময় জেলেদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে হাওড়ে মত্স্য গবেষণাগার ও মত্স্য হ্যাচারি বা প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। প্রতিটি হাওড়ে মত্স্য অভয়ারণ্য রাখা দরকার। এসব মত্স্য অভয়ারণ্যে কখনো মাছ শিকার করা হবে না। এ সবকিছুই বাস্তবায়ন করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে।

হাওড়ের পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজের একটি হলো বিল সেচ দেয়া। জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ী, শুধু জেলেদের সমিতিকে হাওড় বা বিল লিজ দেয়ার কথা থাকলেও কার্যত মত্স্যজীবীদের নামে অমত্স্যজীবীরাই লিজ নিচ্ছেন। এসব অমত্স্যজীবীর অনেকেই সর্বোচ্চ লাভের আশায় বিল সেচে বিষ দিয়ে মাছ ধরে থাকেন। এতে সমূলে মাছের বংশ বিনষ্ট হচ্ছে, পোকামাকড় পর্যন্ত থাকছে না। নষ্ট হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল। বিল-তীরবর্তী গ্রামে পানিরও সংকট দেখা দেয়। শুধু মাছ ধরার জন্য নয়, ধানক্ষেতে পানি দিতে সেচের কাজেও বিল শুকানো হচ্ছে। নীতিমালায় বিল সেচ দেয়া নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে এটি পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। প্রকৃত মত্স্যজীবীদের বিলের প্রতি মায়া থাকে বা পরের বছর মাছ ধরার আশা থাকে বলে তারা সাধারণত বিল সেচ দেয় না। তাই প্রকৃত মত্স্যজীবীদের বিল লিজ দিয়ে এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে বিল সেচ দেয়া ও বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত মত্স্যজীবীদের বিল লিজ দেয়ার নিয়ম থাকলেও লিজের অর্থ ও বিল রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ জোগাড় করতে না পারায় মত্স্যজীবীদের পক্ষে বিল লিজ নেয়া সম্ভব হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মত্স্যজীবী সংগঠনের নামে অমত্স্যজীবীরাই লিজ নেয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য লিজ মানি কমিয়ে দেয়া এবং মত্স্যজীবীদের সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওড়-তীরবর্তী গ্রামের বাড়িঘর রক্ষা করতে অনেকেই চালিয়া বনসহ অন্যান্য জাতের বন দিয়ে প্রতিরোধ দেয়াল তৈরি করে। এজন্য বনের গাছ ও লতাগুল্ম কাটা হয়। তাছাড়া জ্বালানি ও অন্যান্য কাজে প্রচুর গাছ কাটা হচ্ছে। অবাধে বৃক্ষনিধনের ফলে হাওড়ের পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি উদ্ভিদ প্রজাতি বিনষ্ট হচ্ছে। তাই হাওড়ে বৃক্ষনিধন বন্ধে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। একই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। হাওড়ের গ্রামগুলো রক্ষায় কংক্রিটের বা বালির তৈরি ব্লক দিয়ে সুরক্ষা দেয়াল তৈরি করলে নলখাগড়ার ওপর চাপ কমবে।

বিভিন্ন হাওড়ে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। তাই বাঁধ নির্মাণে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ভাটির দেশ হওয়ায় উজানের পানি স্বাভাবিক নিয়মেই ভারতের মেঘালয় থেকে হাওড় এলাকায় আসে। এ পানিকে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ দিলে তা আর আমাদের ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু পলি পড়ে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। নদীর পানি ধারণক্ষমতাও কমেছে। তাই ঢলের পানি উপচে হাওড়ে যাচ্ছে এবং ফসল নষ্ট হচ্ছে। ফসলহানি রোধ করতে হলে নদী খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পলি পড়ে হাওড়েরও তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। এতে শীতকালে কম এলাকাজুড়ে পানি থাকায় হাওড়ের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হাওড়ের সঙ্গে নদীর সংযোগকারী অনেক খালও শুকিয়ে গেছে। তাই নদী, খাল ও হাওড় খনন করতে হবে। এতে ফসল সুরক্ষায় বাঁধের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। বজায় থাকবে হাওড়ের পরিবেশ। তবে খননকালে সতর্ক থাকতে হবে যেন খনন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের ক্ষতি না হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন