গজল : মরু হরিণের আহত গান

জাভেদ হুসেন

উৎস
গজল শব্দটা এসেছে আরবি থেকে। গাযালের মানে হতে পারে মিষ্টি কথা, প্রাণবন্ত মরুভূমির হরিণ। এ শব্দের একটা জনপ্রিয় অর্থ হচ্ছে ‘আহত হরিণের আর্তনাদ’। ঊষর দিগন্তবিস্তৃত মরুর মাঝে শিকারির তাড়া খাওয়া হরিণ যখন তীরবিদ্ধ হয়ে আর ছুটতে পারে না, তখন তার বুক চিরে যে আর্তনাদ বের হয়ে আসে তা-ই গজল। সমস্ত গজলের প্রায় পুরোটাজুড়ে থাকা প্রেমিকের উত্তরহীন প্রেম বারবার এ আর্তনাদের কথা মনে করিয়ে দেবে।
আরবিতে প্রশস্তি কাব্য লেখা হয়। এর নাম কাসিদা। সে কবিতা দীর্ঘ্য। শতাধিক পঙিক্তও থাকে তাতে। এতে প্রেম-ভালোবাসার বালাই নেই। তবে এর সূচনা অংশ কোনো অতীতের সোনালি সময়ের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলত। এর নাম নাসিব। এ আদলেই পরবর্তীকালে আলাদা ছোট কবিতা লেখা শুরু হয়। সেই হলো গজলের শুরু। সপ্তম শতাব্দীতে গজল আলাদা ধরন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেল। সেই সঙ্গে গজলের একটা বিশেষত্ব এসে গেল। গজল মানেই গাওয়ার জন্য লেখা কবিতা। ফলে এর দৈর্ঘ্য, মাত্রা বিন্যাস সব শ্রোতাকে প্রধান ধরে লেখা হয় আজকেও।
প্রসার
ইসলামের সঙ্গে গজলের ফর্ম ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিমে আফ্রিকা, স্পেন আর পূর্বে পারস্য পর্যন্ত। স্পেনে মধ্যযুগে আরবির সঙ্গে হিব্রু ভাষায়ও গজল লেখা হতো। পশ্চিম আফ্রিকার হাউসা ভাষাতে লেখা গজল সুলভ। তবে এ জায়গায় সবচেয়ে বড় রূপান্তর নিয়ে আসে ফারসি গজল। নবম শতাব্দীতে রুদাকি ফারসি গজলের রূপ দিলেন। সেখানে প্রেমের মাত্রা বহুস্তর পেল। সুফিদের ভাবনার হাত ধরে মানবপ্রেমের রূপকে সব প্রেমের প্রকাশ সম্ভব হলো। দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ ফারসি গজল আজকের চেহারা পেয়ে গেল। প্রতিটি পঙিক্ততে আলাদা ভাবনা তুলে ধরা, শেষ পঙিক্ততে কবির নাম দেয়া—এসব তখনই পাকা হয়ে যায়। আজকে আমরা মেহদি হাসান বা গুলাম আলীর কণ্ঠে যে গজল শুনি, এর রূপ সেই সময়ই ঠিক হয়েছে। ভারতবর্ষে গজল এল সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীতে সুফি মরমিদের হাত ধরে। সঙ্গে ছিল সুলতানদের দরবার। এখনো টিকে থাকা প্রথম উর্দু গজল এ সময়ই লিখলেন আমির খসরু। অনেকের মতে, তিনি ছিলেন হাফিজ সিরাজির সমান মাপের কবি। খসরুর সেই গজলের প্রতিটি শেরে এক লাইন ফারসি আরেক লাইন সেই হাটবাজারের অন্ত্যজ মানুষের মুখের বুলি, উর্দুর আদি রূপ, যাকে বলা হতো খাড়িবোলি:
শাবানে হিজরাঁ দারায চু যুলফ ওয়া রোযে ওয়াসলাত চু উম্রে কোতাহ
সখি পিয়া কো জো ম্যায় না দেখুঁ তো ক্যায়সে কাটুঁ আন্ধেরি রাতিয়াঁ
(বিরহ রাত তার কেশরাজির মতো দীর্ঘ, মিলনের ক্ষণ জীবনের মতোই ছোট
সখি প্রিয়াকে যদি না দেখি আমি কেমনে কাটাই এই আঁধার রাত!)
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আমলে বাংলার সোনারগাঁয় ফারসি গজলের বেশ চর্চা হতো। সুলতান এমনকি হাফিজ সিরাজিকে নিজ দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হাফিজ অবশ্য রুকনাবাদ আর মুসাল্লার গোলাপবাগানের মায়া ছেড়ে আসতে পারেননি।
উর্দু গজলের চলন সেই প্রথম থেকেই উপমহাদেশের মাটি-হাওয়া থেকে প্রাণ নিয়ে ফুল ফুটিয়েছে। দাক্ষিণাত্যের সুলতান কুলি কুতুব শাহ বড় কবি ছিলেন। তার কবিতা ছিল বিষয়, প্রকাশের ধরনে একেবারে ভারতীয়। তার উর্দু ছিল দক্ষিণি ভাষার শব্দ আর প্রয়োগ কৌশলে ভরপুর:
পিয়া বাজ পিয়ালা পিয়া জায়ে না
পিয়া বাজ ইক তিল জিয়া জায়ে না
(প্রিয় বিনা পেয়ালা যায় না পান করা
প্রিয় বিনা যায় না এক তিল বাঁচা)
তবে ফারসি সমৃদ্ধ সম্পদকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগিয়ে আজকের মতো গজল বলা শুরু করলেন ওয়ালি দকনি। দকনি মানে দক্ষিণের লোক। আওরঙ্গজেবের আক্রমণে বিপর্যস্ত দাক্ষিণাত্য ছেড়ে দিল্লি এসে তিনি এ নতুন কবিতার সম্ভাবনা জানিয়ে লিখলেন:
রাহে মযমুনে তাযা বন্দ নেহিঁ
তা কায়ামত হ্যায় বাবে সুখন খুলা
(নতুন বিষয়ের পথ বন্ধ হয় না
 কেয়ামত পর্যন্ত খোলা কবিতার দরজা)
এরপর উর্দু কাব্যে গজল লেখকদের বসন্ত এল। মীর তকি মীর, মির্জা রফি সওদা, মির্জা গালিব, আল্লামা ইকবাল হয়ে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, নুন মিম রাশিদ, আহমদ ফারাজ থেকে আজও ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয়া ২৪ বছর বয়সী কবি কমর আব্বাস ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে গজল লিখে যাচ্ছেন। ২০১৯ সালেও খোলা মাঠে দিল্লিতে হাজার দশেক শ্রোতা এ তরুণ কবির গজল শুনে হাহাকার করে ওঠেন:
রোনা ইলাজে যুলমাতে দুনিয়া নেহিঁ তো কেয়া
কম আয কম এহতিয়াযে খুদায়ি হ্যায় রোইয়ে
(কান্না এই জগতের অন্ধকারের প্রতিকার নয়, না-ই হলো
কারো সর্বশক্তিমান হওয়ার দাবির প্রতিবাদ তো হয়, কাঁদো)
বিষয়
গজল কবিদের অনেকেই ছিলেন নিজেরা সুফি নয়তো সেই ভাবনার অনুসারী। বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী, খাজা মুইনউদ্দিন চিশতি, বাবা ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর—বড় সুফি সাধকদের অধিকাংশ নিজেরা ছিলেন বড় কবি। তাদের ভাবনার প্রভাবে প্রত্যেকটি গজলের প্রেমাষ্পদকে কখনো খোদা, কখনো কবির মুর্শিদ (ঈশকে হাকিকি) আর চাইলে যেকোনো মানব-মানবীর প্রেম (ঈশকে মাজাযি) হিসেবে পাঠ করা যায়। এ সুফি প্রেমের আদলেই গজলের প্রেমের পরম্পরা গড়ে উঠেছে।
গজল কোনো না কোনোভাবে প্রেমের কথা বলে। সেই প্রেম কখন যে ব্যক্তি আর কখন ব্যক্তিকে পরমের প্রেমে তুলে নিয়ে যায়, সে কথা বুঝে ওঠা মুশকিল। কবি প্রেমকেই সার বলে মানেন। এখানে প্রেমের আরাধ্যকে অতিক্রম করে খোদ মুখ্য হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এমন অবস্থাকে বলছেন: আর পাব কোথা! দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।
মীর তকি মীর খোদ সৃষ্টির শুরুই দেখতে পান প্রেমের মাঝে:
মুহাব্বত নে যুলমাত সে কাড়া হ্যায় নুর
না হোতা ইশক না হোতা যুহুর
(তমসা হতে প্রেম কেড়েছে আলো
প্রেম না হলে হতো না প্রকাশ)
জগৎ ছিল অব্যক্ত হয়ে। অব্যক্ত মানে অন্ধকার। সেই অন্ধকার হতে প্রেম আলো কেড়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই প্রেম এল কোত্থেকে? প্রেম এসেছে নিঃসঙ্গতা থেকে, নিজেরই রূপ নিজে দেখার বাসনা থেকে। আসগর গওন্ডভি বলছেন:
জো নকশ হ্যায় হসতিকা ধোখা নযর আয়া
পর্দে মেঁ খুদ মুসাব্বির হি তানহা নযর আয়া
(অস্তিত্বের এসব চিহ্ন ধোঁকা দেখতে পেলাম
সৃষ্টির আড়ালে খোদ স্রষ্টাকেই নিঃসঙ্গ দেখতে পেলাম)
পুরো দৃশ্যমান জগৎ কোনো পরম সত্যের নিজেরই প্রকাশের অংশ। ফলে আয়নায় যখন নিজেকে দেখি, তখন তো সেই পরম সত্যেরই ছবি দেখি! কিন্তু দৃশ্যের আতিশয্যে বিহ্বল চোখ তা চিনতে পারে না। ফলে কবির চাওয়া:
দেনা হ্যায় তো আঁখ কো এয়সি রাসায়ি দে
ম্যায় আয়িনা দেখুঁ তো মুঝে তু দিখায়ি দে
(দিতে হলে দৃষ্টিকে এমন দেখার ক্ষমতা দাও
যেন আমি আয়না দেখলে তোমাকে দেখতে পাই)
কিন্তু এক আর বহুকে নিছক আছে আর নেইয়ের ছক বাঁধা হিসাবের মধ্যে তিনি বাঁধতে নারাজ। কবি জানেন, সুন্দরকে নিছক ব্যক্তিগত করে ফেলা যায় না। সুন্দরকে নিজের করা বাতুলতা। বরং নিজে সুন্দরের হয়ে যাওয়ার মাঝে চাওয়া আর পাওয়ার বিলয় ঘটানো যায়। ফলে এখানে নিছক একনিষ্ঠতার আটপৌরে মানে আর কাজ করে না:
হুস্নে পাবন্দে ওয়াফা হো মুঝে মনযুর নেহিঁ
ম্যায় কহুঁ তুম মুঝে চাহো মুঝে মনযুর নেহিঁ
(সুন্দর একনিষ্ঠায় বাঁধা থাকবে আমি চাই না
 আমি বলি কি—তুমি আমায় চাও, তা আমি চাই না)

গজলের শ্রুতিনির্ভরতা: নজির
গজলে কবিরা শব্দ ব্যবহার করেন খুব হিসাব করে। একেকটা শব্দ মুক্তোর মতো দামি। এর অপব্যবহার মানা যায় না। আর একেকটা শব্দ প্রায় হাজার বছর ধরে কবিরা বহু রকমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করেছেন। ফলে এদের নিয়ে যাচ্ছেতাই করা যায় না। এ মিতব্যয়িতার নমুনা দেখা যায় মির্জা গালিবের শেরে:
তামাশায়ে গুলশান তামান্নায়ে চিদন
বাহারে আফ্রিঁ গুনাহগার হ্যায় হাম
এর শাব্দিক অর্থ:
পুষ্পকুঞ্জ দেখা, চয়নের বাসনা
বসন্তের স্রষ্টা, আমি পাপী
মুশায়রায় গজল পরিবেশনা একটা পারফর্মিং আর্ট। কোনো কোনো কবি গজলের ভেতরে বোনা সুরকে অবলম্বন করে নিজের কালাম সুর করে পাঠ করেন। একে বলে ‘তারান্নুম কে সাথ পঢ়না’। মুশায়রার মাঝে গজল কেমন করে শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলে, সেটা এক দেখার মতো অভিজ্ঞতা হতে পারে। কবিরা গজল লেখেন না। তারা গজল বলেন। গজলের মধ্যে হাসিলে গজল শের আছে। তেমন গজল পাঠ হলে বাকি কবিরা সেই গজলের সম্মানে নিজেদের গজল আর না পড়ে মুশায়রার মাঝেই নিজেদের লেখা গজলের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দেন। এর মানে আজ আর আমাদের গজল পড়ার প্রয়োজন নেই। মুশায়রার দর্শক-শ্রোতাও খুশি মনে ফিরে যেন এই ভেবে যে আজ এক মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হলো! সাবেকি কায়দার মুশায়রায় একজন নাযামত মানে পরিচালনা করতেন। তার কণ্ঠস্থ থাকত হাজারো কবিতা। কবিদের বসার জায়গায় মেঝেতে ফরাশ পাতা, তার ওপর মোটা বালিশ। কবিরা তাতে হেলান দিয়ে বসবেন। মাঝখানে রাখা এক অলংকৃত বড় প্রদীপ। যে কবির নাম এল তার সামনে সেই ‘শামায়ে মাহফিল’ মানে আসরের প্রদীপ রাখা হবে। তিনি তখন নিজ গজল বলবেন।
কবির নাম ঘোষণা হলো। প্রদীপ তার সামনে রাখা হলো। তিনি সদরে মাহফিল, মানে সভাপতি সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কবির অনুমতি নিয়ে গজলের প্রথম শের মানে পঙিক্ত পড়া শুরু করলেন। এ শেরের বহুবচন হলো আশআর। কবি গজলের প্রথম শেরের প্রথম লাইন বললেন। গজলের এ প্রথম শেরকে বলে মাতলা। প্রতি লাইনকে বলে মিস্রা। এ লাইন তিনি দুবার, তিনবার পড়লেন:
কঠিন হ্যায় রাহগুযার থোড়ি দূর সাথ চলো
মানে, এ চলার পথ বড় কঠিন, কিছু দূর সঙ্গে চলো। প্রতিবার পড়ার মাঝে কবি লাইন পড়ার সমান সময় থামবেন। শ্রোতারা সেই লাইন নিজেরা গুন গুন করবেন। একে বলে ‘মিস্রা উঠানা’। আসলে এ পুনরাবৃত্তির মাঝে শ্রোতা তার হাজার বছরের কালেক্টিভ মেমোরি থেকে ঝালাই করে নিচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করছে এমন কবিতা তার পড়া হয়েছে কিনা! এদিকে কবি এ লাইনে যা বলছেন, তাতে কায়দা-কানুন আছে। এই যে লাইনের শেষে বলা হলো—থোড়ি দূর সাথ চলো, একে বলে রাদিফ। এ রাদিফ প্রথম শেরের দুই লাইনের শেষেই ফিরে আসবে। আর রাদিফের আগে যে রাহগুযার শব্দটি আছে, এর শেষ ধ্বনি, মানে ‘র’ ধ্বনিটিও প্রতি রাদিফের আগে থাকতে হবে। এখন কবি বারবার পড়ছেন আর শ্রোতারা মেলানোর চেষ্টা করছেন যে দ্বিতীয় মিস্রা কী হতে পারে। শ্রোতার কাছে অধিকাংশ নিশানাই আছে। দ্বিতীয় লাইনেও যেহেতু ‘থোড়ি দূর সাথ চলো’ থাকবে, এর আগে ‘র’ ধ্বনিও থাকবে, তার মানে কবির হাতে আছে মাত্র তিনটি শব্দ, এর একটি আবার ‘র’ দিয়ে শেষ হতে হবে। কবি প্রথম লাইন বারবার পড়েন আর শ্রোতারা উত্তেজিত হতে থাকেন। কী বলতে পারেন কবি এই তিনটি মাত্র শব্দ দিয়ে? কবি এবার পুরো পঙিক্ত মানে গজলের প্রথম শের পড়লেন, যাকে মাতলা বলা হয়:
কঠিন হ্যায় রাহগুযার থোড়ি দূর সাথ চলো
বহোত গড়া হ্যায় সফর থোড়ি দূর সাথ চলো
মানে,
এ চলার পথ বড় কঠিন, কিছু দূর সঙ্গে চলো
বড় অনিবার্য সফর, কিছু দূর সঙ্গে চলো
শ্রোতাদের সব জল্পনা-কল্পনা এবার শেষ হলো। চারদিকে বাহ! বাহ! রবে জোয়ার বয়ে গেল। কবি এবার দ্বিতীয় শের পড়া শুরু করলেন:
য়ে শব কি মুলাকাত ভি গনিমত হ্যায়
মানে, এই এক রাতের দেখা পাওয়াও অমূল্য সম্পদ। এ মিস্রায় মানে দ্বিতীয় পঙিক্তর প্রথম লাইনে একই ছন্দ মেনে বলা হলো। তবে তাতে রাদিফ কাফিয়া নেই। গজলের প্রতিটি শের একটি স্বতন্ত্র কবিতা। প্রত্যেকটির বিষয় আলাদা। এখন দ্বিতীয় শেরের প্রথম লাইন পড়া হলো। সেও কয়েকবার। শ্রোতারা আগের মতোই পুনরাবৃত্তি করছেন। আগের মতোই কল্পনা করে মেলানোর চেষ্টা করছেন। কারণ দ্বিতীয় যে লাইন দিয়ে শের পুরো হবে, তাতেও রাদিফ কাফিয়া থাকবে। মানে কবির হাতে সেই মাত্র তিনটি শব্দ। সাস্পেন্স ক্রমেই চূড়ান্ত হচ্ছে। কবি বারবার লাইনটি পড়ছেন। শেষে কবি পড়লেন:
য়ে শব কি মুলাকাত ভি গনিমত হ্যায়
কিসে হ্যায় কালকি খবর থোড়ি দূর সাথ চলো
(এই এক রাতের দেখা পাওয়া অমূল্য সম্পদ
কে জানে কালকের কথা, কিছু দূর সঙ্গে চলো)
আবার চমকে ওঠা শ্রোতাদের দাদ, মানে প্রশংসার জোয়ার, বাহ বাহ জোয়ার।
এমনি করে কবি শের পড়তে থাকবেন। শেষ শেরে এসে চমক বাড়বে। কারণ এই শের, যাকে মাতলা বলে, তাতে কবির নাম থাকবে। বাংলায় ভণিতার মতো এই কবিনামকে বলে তাখাল্লুস। শেষ শের পড়া শুরু করলেন কবি:
তাওয়াফে মনযিলে জানাঁ হামে ভি করনা হ্যায়
মানে হলো আমিও প্রিয়র গন্তব্যের পরিভ্রমণ করব। উর্দু কবিরা প্রিয় যেখানে প্রেমাষ্পদকে দেখা দেন, তারই পরিভ্রমণের কথা কথা বলেন। নিজের প্রিয়র ঘরের ঠিকানা অন্য কেউ পেয়ে যেতে পারে বলে তারা প্রশ্নকর্তাকে ভুল পথ দেখিয়ে দেন। এ জায়গায় কবিরা নিতান্ত বল্গাহারা। একটা ফারসি শেরের নমুনা দিলে ব্যাপারটা টের পাওয়া যাবে:
পা এ সগ বোসিদা মজনুঁ শখস এ পুশত য়ে চিস্ত
গুফত য়ে সগ গাহে গাহে রাহে লায়লা রফত বুদ
অর্থাৎ মজনু এক কুকুরের পায়ে চুমু খেল। তাই দেখে একজন আশ্চর্য হয়ে বলল, এ কী কাণ্ড! মজনু তাকে বুঝিয়ে বললেন যে লায়লার বাড়ি যে রাস্তায় এই কুকুর সেই পথে মাঝে মাঝে যায়। ফলে ওর পায়ে লায়লা যে পথে আসা-যাওয়া করে, সেই পথের ধুলো লেগে আছে। আর যে পায়ে সেই ধুলো লেগে আছে তাকে চুমু না খেয়ে মজনু কী করে থাকতে পারেন?
তো যাক, কবি বারবার পড়ছেন যে প্রিয়র গন্তব্য পরিভ্রমণ করতে হবে। এটা বলছে তৃতীয় কোনো পক্ষ। আমিও প্রিয়র গন্তব্যের পরিভ্রমণ করব, অর্থাৎ এ পরিভ্রমণ জগতে বড়ই সুলভ, কে না করতে চায়! শ্রোতারা ভাবছেন, দ্বিতীয় লাইনে যে তিনটে শব্দ ছিল কবির ভাগে, তার থেকে আরো একটা এবার কম। কারণ কবির নাম আসবে শেষ লাইনে। কবি এবার পড়লেন:
ফারায, তুমভি আগার হবে থোড়ি দূর সাথ চলো
ফারায, তুমিও যদি কিছু দূর সঙ্গে চলো।
কবি প্রথাগত আচরণের বাইরে নিজের প্রিয়র গন্তব্যের পরিভ্রমণের যে নতুন নিয়ম চালু করছেন, জগজ্জন সেই ভ্রমণে কবির সঙ্গ ভরসা চান।
গজলের আজ
গত প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছরে আরবি, তুর্কি, ফারসি, উর্দুতে উত্কৃষ্ট গজল লেখা হয়ে আসছে। লেখা হয়েছে মধ্য এশিয়ার তুর্কি শাখার ভাষায়। গজল গাওয়া হয়ে আসছে উজবেক-তাজিক শাশমাকোম, তুর্কি মাকাম, ফারসি দস্তগাহ আর উইঘুর মাকামের সংগীত ঘরানায়। ভারতবর্ষের গজল গায়কি এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। টপ্পা আঙ্গিকের এ গায়কি বেশ পুরনো। আজকের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম গজল গায়ক কেএল সায়গাল। এরপর মালিকায়ে গজল বেগম আখতার, মেহদি হাসানের মতো গায়কেরা গজলকে বিপুল জনপ্রিয় এক শিল্পে নিয়ে যান। বোম্বে সিনেমায় গজল নিজেই এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছে।
ভারতবর্ষে উর্দু গজলের সঙ্গে গুজরাতি ভাষায় কবিতা আর গান হিসেবে গজল খুব জনপ্রিয়। তেলেগু, কন্নড় ভাষায় গজল অন্যতম প্রিয় গান ও কবিতা হয়ে আছে শতবছর ধরে। মারাঠি ভাষায় গজল গেয়ে নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন লতা মুঙ্গেশকার আর আশা ভোসলে। ইংরেজিতে গজলের আঙ্গিককে দাঁড় করান আড্রিয়ান রিচ, ফিলিস ওয়েবের মতো কবিরা। বাংলা ভাষায় অবশ্য গজল ফর্মটি সফলতা পায়নি। নজরুলের যে গানগুলো গজল হিসেবে পরিচিত, তার দু-একটি ছাড়া আর কোনোটিই গজল নয়। নজরুলের গজল লেখার সে ক্ষমতা ভালোমতোই ছিল। তবে সেই সময় ঠিক এ ধরনের কঠোর ফর্মভিত্তিক নিরীক্ষার চল ছিল না। কেবল আরবি-ফারসি শব্দ, শরাব-সাকি ব্যবহারই হয়তো এদের গজল বলে পরিচিত করেছে। আমেরিকার বিখ্যাত লেখক কবি জিম হ্যারিসন এ ফর্মকে অবলম্বন করে লেখেন তার আউটলেয়ার অ্যান্ড গজলস গ্রন্থ।
গজলের হাজার বছরের পথচলা এখনো গতি কমায়নি। এখনো নিজের মাঝে একা একটু একটু করে মরতে মরতে গুমরে ওঠা মানুষ নিজের একাকিত্বকেই কখনো অবলম্বন করে তোলে। এ একাকিত্বকে নিজের একা হয়ে যাওয়ার হাতিয়ার দিয়ে রুখে দিতে গেলে গজল হয়ে ওঠা ঠেকানো যায় না।
বজমে তানহায়ি মেঁ গুযরে হুয়ে লমহোঁ কা জুলুস
ইশক কা শাম্মা জ্বালায়ে তো গজল হোতি হ্যায়
(নিঃসঙ্গতার আসরে কাটিয়ে আসা মুহূর্তের মিছিল
প্রেমের প্রদীপ জ্বালায় যখন, সে গজল হয়ে ওঠে)

জাভেদ হুসেন : উর্দু-ফারসি সাহিত্য গবেষক ও অনুবাদক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন