১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ সূর্য আরব সাগরের জলের তলে হারানোর আগেই অস্তমিত হলেন মীনা কুমারী। পরদিন সকালে নার্গিস লিখলেন, ‘মওত মুবারক হো। আর কখনো এ দুনিয়ায় ফিরে এসো না মাহ্জাবীন।’ সমাপ্ত হলো উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী মীনা কুমারীর জীবনের যত ট্র্যাজেডি—জানাজায় ফুল দিলেন ধর্মেন্দ্র, আর গুলজার মীনার কবরে ছড়িয়ে দিলেন কিছু নুড়ি পাথর। মীনা কুমারী নতুন যে জায়গায় যেতেন, সেখান থেকেই নাকি কিছু মাটি সংগ্রহ করে আনতেন। নিজের কবিতার খাতার সঙ্গে এ নুড়ি পাথরও তিনি একদিন রাখতে দিয়েছিলেন প্রিয় গুলজারকে। প্রয়াণের পর সে বছরই গুলজারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মীনা কুমারীর লেখাজোকার সংকলন তানহা চান্দ (নিঃসঙ্গ চাঁদ)। ২০১৪ সালে মীনা কুমারীর কবিতা ও নজমের সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয় মীনা কুমারী, দ্য পোয়েট: আ লাইফ বিয়ন্ড সিনেমা। হ্যাঁ, সিনেমার দুনিয়ার জাঁকজমক, জনপ্রিয়তা বিতর্কের বাইরে মীনা কুমারী ছিলেন একজন নিমগ্ন কবি—প্রেম আর নিঃসঙ্গতার কবি।
মীনা কুমারীর একটি বিখ্যাত গজল এ রকম—
চান্দ তানহা হ্যায় আসমা’ন তানহা
দিল মিলা হ্যায় কাহা কাহা তানহা
...জিন্দেগি কেয়া ইসি কো কেহতে হ্যায়
জিসম তানহা হ্যায় অওর জান তানহা
রাহ দেখা কারেগা সাদিয়ো তক
ছোড় যায়েঙ্গে ইয়ে জাঁহা তানহা।
তার গজলের কথার মতো ব্যক্তিজীবনেও কি এক একাকিত্ব বয়ে বেড়িয়েছেন মীনা কুমারী, বলিউডের ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তি এবং তার কালে জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়েও তার কবিসত্তা এবং শব্দের সংবেদনশীলতা পাঠককে বিস্মিত না করে পারে না।
মীনা কুমারী কিংবদন্তি অভিনেত্রী শুধু নন, একজন কবিও। নায নামে তিনি কবিতা, গজল, শায়েরি লিখেছেন। তার কাব্যচর্চা নিয়ে ঐতিহাসিক-গবেষক ফিলিপ বাউন্ডস ও ডেইজি হাসান লিখেছেন, ‘কবিতার মধ্য দিয়ে মীনা কুমারী নিজেকে গণপরিসর থেকে সরিয়ে রাখতেন। কবিতা দিয়ে সমালোচনা করেছেন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে, যে ইন্ডাস্ট্রি তাকে মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে এনে ফেলেছিল। এ বিবেচনায় তার কবিতা যতটা না তার নিজের সম্পর্কে বলে, তার চেয়ে বেশি জানায় বলিউড সম্পর্কে।’
কবি, গীতিকার গুলজারের সঙ্গে মীনা কুমারীর বন্ধুত্বের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, তখন গুলজারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গুলজারই মীনা কুমারীর মৃত্যুর পর তার কবিতা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। তানহা চান্দ বইটি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি বইটির পাইরেটেড কপিও বিক্রি হতো। তারপর ধীরে ধীরে বইয়ের পাতাগুলো যেমণ বিবর্ণ হয়েছে, তেমনি মীনা কুমারীর কবি পরিচয়টিও হারিয়ে গেছে। এ যুগে সিনেমা নিয়ে ওয়াকিবহাল তরুণ নায়িকা মীনা কুমারীর নামটি জানলেও তার কবি পরিচয়টি নিশ্চয়ই অনেকের জানা হয়ে ওঠে না।
কোনো এক সাংবাদিক একবার মীনা কুমারীকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি অভিনয় করে লেখালেখি করার সময় পান কখন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘লেখার জন্য খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না। ইচ্ছা থাকলে আপনি লিখতে পারবেন।’ কাব্যচর্চায় তার আকর্ষণ এ জবাবে স্পষ্ট হয়। গজল, কবিতা, নজম লিখেছেন মীনা। তার কণ্ঠ ছিল ‘খাঁটি সোনা’, গজল কিংবা নযম গাইতেন এবং আবৃত্তি করতেন মাঝে মধ্যেই।
বিশ শতকের শেষভাগে উর্দু কাব্যের জগতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নারী লেখকের উপস্থিতি দেখা যায়। পারভিন শাকির (১৯৫২-৯৪), কিশওয়ার নাহিদ (১৯৪০-) বিখ্যাত কবি। আরো পাওয়া যায় অ্যাক্টিভিস্ট ফাহমিদা রিয়াজ ও জেহরা নিগারকে। এরা সবাই উর্দু কাব্যের পুরুষ আধিপত্যে নারীর কণ্ঠস্বর নিয়ে হাজির হন। পাকিস্তানের এ নারীবাদী কবি ও অ্যাক্টিভিস্টরা গজলকে ব্যবহার করেছেন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বিভিন্ন বিষয়ে আওয়াজ তুলতে। তারা গজলে তুলে ধরেছেন কন্যা ভ্রূণহত্যা, যৌতুক প্রথা, বিয়েকে বস্তুগত লাভ-ক্ষতির বিষয় করে তোলাসহ সমাজে নারীর প্রতি বিদ্যমান সব ধরনের লিঙ্গবৈষম্যের প্রচলনকে।
গজলের দুনিয়ায় এ নারী কবিদের কলমের আবির্ভাবের আগে উপমহাদেশের গজল সাহিত্য ছিল একেবারেই পুরুষ কবি ও বিষয়নির্ভর। গজলে বারবার পুরুষ কবিদের চোখে নারীর, প্রেমিকার সৌন্দর্যই কেবল হাজির হয়েছে। নারীকে ফেলা হয়েছে বাঁধাধরা বিভিন্ন পরিচয়ের ছকে। দিল্লিভিত্তিক কবি, অনুবাদক, লেখক সাইফ মাহমুদ এক সাহিত্য উত্সবে বলেছিলেন, ‘প্রাথমিক কালের উর্দু কবিতা সবসময়ই ছিল নারীকেন্দ্রিক। এসব কবিতা থাকত নারীর বর্ণনায় পূর্ণ। নারী ছিল হয় নিষ্ঠুর প্রেমিকা, নয়তো সে এত সুন্দর, যা শব্দে বর্ণনা করা যায় না।’
গজলে নারীদের কণ্ঠকে যারা হাজির করেছিলেন, কিশওয়ার নাহিদ তাদের অন্যতম। তার জন্ম ১৯৪০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দ শহরে, দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে তার পরিবার পাকিস্তানের লাহোরে চলে যায়। সে সময় মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছিল কম এবং শিক্ষা গ্রহণের জন্য কিশওয়ারকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার হাম গুনাহগার অওরাতে (আমি পাপী নারী) পাকিস্তানের উর্দু ও নারীবাদী সাহিত্যের এক তীব্র উচ্চারণ।
সাইফ মাহমুদের কথায়, ‘ইউরোপ ও আমেরিকায় নারীবাদী চর্চা শুরু হয়েছে বেশ আগে। দেরিতে হলেও উর্দু কবিতায় নারী কবিদের আগমন গজলের গতিপথকেই বদলে দিয়েছে। এ নারী কবিরা বিশেষ হয়ে উঠেছেন নারীবাদী ইস্যুতে তাদের সাহসী উচ্চারণের কারণে।’
পারভিন শাকির পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু স্বৈরশাসনের আমলেও তার গাজলইয়াতে ছিল প্রেম, সৌন্দর্য, ঘনিষ্ঠতা, বিচ্ছেদ, অবিশ্বস্ততা, অবিশ্বাসের মতো বিষয়ে নারীবাদী প্রেক্ষিত থেকে তৈরি করা শব্দমালা। পাকিস্তানের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এ ছিল এক বিরাট আলোড়ন।
উনিশ শতকে অনেক পুরুষ কবি তাদের গজলে নারীদের স্বাধীনতা ও সমঅধিকার বিষয়ে লিখেছেন। আলতাফ হুসেন হালি তার গজলে কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যার বিরুদ্ধে বলেছেন। অনেক গজল লেখক পর্দা প্রথার কঠোরতার বিরুদ্ধেও লিখেছেন। সাইফ মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘উর্দু কাব্যে নারীবাদী আন্দোলন উনিশ শতকের শুরুতেই আরম্ভ হয়েছিল এবং সে বীজ বপন করেছিলেন পুরুষ কবিরাই।’
শানজিদ অর্ণব: লেখক ও সাংবাদিক