গজলের গতিপথ

পারস্য যেভাবে গজলের জনপ্রিয় রূপ নির্মাণ করেছিল

সাহিত্যের বাকি সব ফর্মের তুলনায় গজলের বিবর্তন ও বিস্তারের কাহিনী অনেকটাই আলাদা। নিছক উত্পত্তিস্থলের সীমানা ছাড়িয়ে গজল বৃহৎ পরিসরে এবং একাধিক ভূখণ্ডে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কাব্যকলার এ বিশেষ রূপটির ইতিহাসে ফিরে তাকালে বা এর বিচিত্র যাত্রাপথের দিকে আলোকপাত করলে আমরা বুঝতে পারব গজলের স্বাতন্ত্র্য আর বৈশ্বিক আবেদন ঠিক কীভাবে তৈরি হয়েছিল। গজল যখন প্রথম প্রথম আরব উপদ্বীপের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তা সমাদরের সঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছিল মধ্যযুগের স্পেনে, যেখানে গজল লেখা হতো একই সঙ্গে আরবি ও হিব্রু ভাষায়। অন্যদিকে এও দেখা যায়, ওই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় প্রচলিত নানা ভাষায়ও গজল রচিত হচ্ছিল; যেমন হাউসা ও ফুলফুলদে। অবশ্য স্পেন ও পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে রচিত গজল কিঞ্চিৎ ভূমিজ নিজস্বতা বা স্বকীয়তা ধারণ করার পরও শেষ অবধি কিন্তু গজল রচনা আরবীয় মডেলের দিকেই ঝুঁকে ছিল। আরব অঞ্চলে প্রচলিত গজল রচনার ছন্দ ও গঠনশৈলী এর স্পেনীয় ও আফ্রিকি রচয়িতারা প্রায় হুবহু মেনে চলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্যে গজলের প্রচলন ঘটার পর দেখা গিয়েছিল, সেখানে গজল রচয়িতারা আরবীয় গজল রচনার আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিমার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদ না ঘটিয়েই গজলের একটি স্বতন্ত্র তথা পারসিক ধারার নির্মাণ আরম্ভ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরো পরে পারস্যের গজল তার সুনির্দিষ্ট চারিত্র্য অর্জন করে গজলের প্রথম শের বা দ্বিপদীর মধ্যে এক ধরনের নিজস্বতার চকমকে পালিশ দেয়ার মাধ্যমে। এবং একটি গজলের প্রতিটি শেরের দ্বিতীয় পঙিক্তর শেষ শব্দটি একই রাখার যে পুনরাবৃত্তিপূর্ণ অথচ দারুণ মনোমুগ্ধকর রীতি—‘রাদিফ’—তারও প্রচলন হয়েছিল পারস্য থেকেই। প্রত্যেক গজলের দৈর্ঘ্য সাত থেকে ১৫ শেরে আবদ্ধ রাখার রীতিটিও পারস্যে প্রথম প্রচলিত হয়। পাঠক জেনে আরো আশ্চর্য হবেন, গজলের অন্তিম শের অথবা ‘মাকতা’য় কবিরা যে নিজেদের নাম করে প্রায়ই হাহাকারে-ক্রন্দনে ডুবে যান, শেষ লাইনে নিজের পরিচয়ের সিলমোহর বসিয়ে দেয়ার এ চমত্কার নিয়মটিও একান্তই পারসিক গজলধারার উদ্ভাবন। সেই হিসেবে বলতে গেলে আজকে গজলের যে জনপ্রিয় রূপটি শ্রোতাদের সামনে হাজির হয়, তা কার্যত পারস্য থেকে আসা।
আবদুল্লাহ জাফর রুদাকিকে বলা হয় প্রথম প্রধানতম পারসিক গজল রচয়িতা। তার আবির্ভাব ঘটেছিল নবম শতাব্দীর শেষ দিকে। তারপর আরো অনেক কিংবদন্তিতুল্য মহান গজল রচয়িতার আবির্ভাব ঘটে সেখানে। যেমন বারো শতকে সানাই গজনভি, ফরিদউদ্দিন আত্তার; তেরো শতকে সাদি শিরাজী ও জালালউদ্দিন রুমি; চৌদ্দ শতকে হাফিজ শিরাজী। চিরায়ত পারসিক মডেলের নির্মাণের পর সেখানকার গজল পরবর্তী শতকগুলোয় আরো বেশি পরিপক্ব হয়ে উঠতে থাকে। কার্যত পারস্যের গজল তার দুটি জোরালো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে সর্বদাই বিশ্ববাসীর কাছে একটি আলাদা আসনে ঠাঁই পেয়ে এসেছে। ওই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর বাণীর মধ্যে বিরাজমান তীব্র আধ্যাত্মিক নিমগ্নতা ও তীক্ষ দার্শনিক চিন্তা। ফারসি ভাষায় রচিত গজল মধ্য এশিয়া ও ভারত ভূখণ্ডেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। কেননা ওই দুই এলাকায় তখন ফারসি ছিল শাসকদের ভাষা। ফলে শক্তপোক্তভাবেই গজল প্রাচ্যবাসীর কাব্যিক অভিব্যক্তি প্রকাশের এক আদি ও অকৃত্রিম রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় বৈকি।
এমনকি অন্যান্য ভাষায় যেসব ভিনদেশী কবি তখন লিখতেন, তারাও একটি পরিপূর্ণ কাব্যিক প্রকরণের সন্ধান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তাকিয়ে ছিলেন পারস্যের গজলের দিকেই। যেমন তুরস্কের কথাই ধরা যাক। তুর্কভূমিও একসময় গজলের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছিল। সেখানে তৈরি হয়েছিল পারস্যে প্রচলিত গজলের ভিন্ন আরেক রকম রূপ। আফগান বংশোদ্ভূত কবির আলি শের নাভাই, যাকে উজবেক সাহিত্যের জনক বলে বিবেচনা করা হয়, তিনি গজলকে নতুন ভাষিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মারফত তুরস্কে একদা প্রচলিত অধুনা বিলুপ্ত চাগতাই ভাষায় উপস্থাপন করেছিলেন পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ষোলো শতকের গোড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের আরেক কবি মুহম্মদ বিন সুলাইমান ওরফে ফুজুলি গজলকে বাণী ও সুর—দুইসমেত উপস্থাপন করেছিলেন আরবাইজানি তুর্কি ভাষায়।

গজলের ভারত জয়
গজলের জন্মস্থান আরবভূমি এবং যে ভূখণ্ডে এসে তা পরিপূর্ণতা পেয়েছিল সেই পারস্য অঞ্চল—পূর্বোক্ত ওই দুই এলাকায় গজল চূড়ান্ত সমাদর পায়নি। কিন্তু দিনের শেষে এসে দেখা গেল, গজল অসামান্য স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ ভারতীয় উপমহাদেশেই। এবং এখানে বেশির ভাগ গজলই রচিত হয়েছে উর্দু ভাষায়। যেন তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ছিল এটাই! যদিও আমির খসরু তেরো শতকেই গজল লিখেছেন বলে তার রচনাবলি ঘাঁটলে প্রমাণ মেলে; তবে প্রকৃত উর্দু গজলের আদিপর্বের রচয়িতা হিসেবে ষোলো শতকের শেষার্ধে গোলকণ্ডার কুতুব শাহি বংশের সুলতান মোহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ ও দাক্ষিণ্যাতের সতেরো শতকের কবি ওয়ালি আওরঙ্গাবাদিকেই ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করেছেন। ভারতে গজল রচনার ধারা ফর্ম, ভাষা ও বিষয়ের দিক থেকে বেশ কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে এ অবধি বিবর্তিত হতে হতে এসেছে বলে পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে দক্ষিণাত্যে গজল রচনা প্রথম শুরু হলেও তা ক্রমে ক্রমে ভারতের নানা দিকে দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিখ্যাত সাহিত্যকেন্দ্র হিসেবে সব শহরে, যেমন দিল্লি বা লক্ষেৗতে গজল রচনা করাটা চটজলদি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। শহরগুলোর কবিদের মধ্যে গজল লেখা নিয়ে প্রতিযোগিতাও আরম্ভ হয় রীতিমতো। ধীরে ধীরে পুরো ভারত ভূখণ্ডের চারদিকেই গজল ছড়িয়ে পড়ছিল। এভাবে ভারতীয় গজলও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পালক গায়ে এক এক করে জুড়ে নিচ্ছিল সরবেই। ভারতের নানা প্রান্তে অনেক কবিই তখন গজল লিখেছেন ধুমসে, যা কিনা এখানকার গজলকে এক বৃহৎ পরিসরের দিশা দেখিয়েছিল এবং বহুবিস্তৃত বিষয়কে ধারণ করার শক্তি জুগিয়েছিল। আদতে নির্দিষ্ট কেউ নন, বরং আদিপর্বে গজল রচয়িতা সব কবিই ভারতীয় উপমহাদেশে গজলের এ রকম সুবিশাল ও স্থায়ী ঐতিহ্যের জমিটুকু নিংড়ে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। মির্জা গালিব, মির তকি মির বা জওকের মতো কবিরা যেমন, তেমনি ওয়াজিদ আলী শাহ বা বাহদুর শাহ জাফরের মতো নিজভূমে পরবাসী নির্বাসিত রাজপুরুষেরাও উপমহাদেশে গজল রচনার ঐতিহ্যকে বৈচিত্র্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ করেছেন।
ভারতীয় গজলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো বিভিন্ন ভাষার এবং একাধিক ধর্ম ও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের কবিরা একই সঙ্গে একই সময়ে গজল লিখেছেন, লিখে চলেছেন। এখন এটা বেশ স্পষ্ট যে বিভিন্ন ধারার কবিরা একত্র হওয়ায় গজলের পরিসীমা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বিষয়গত ও শৈলীগত—এ দুদিক থেকেই অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে। আকারে-প্রকারে বেড়েছে, যা কিনা আরব বা পারস্য ভূখণ্ডে এতটা ব্যাপকরূপে ঘটা কঠিন ছিল। পারস্যে যেমন আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিক কথকতাই ছিল গজলের মুখ্য বিষয়, প্রেমিকমনের বয়ানও সেখানে শেষ বিচারে আধ্যাত্মচেতনায় সমর্পিত—ভারতীয় উপমহাদেশের গজলের বিষয় ঠিক অতখানি গুরুতর বিষয়াবলিতে বন্দি থাকেনি। প্রেমিকের মনের হাহাকার থেকে শুরু করে রাজ্য হারানো রাজার দুঃখগাথা—উর্দু গজলের বৈচিত্র্য এমনই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে প্রবাহিত। এ কারণে গজল যেমন উপনিবেশপূর্ব ভারতীয় কবিদের মধ্যে কাব্যচর্চার ফর্ম হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছিল, তেমনি সংগীতের বাণীরূপেও এর জনপ্রিয়তা রাজদরবার কি অভিজাতগৃহ থেকে সংগীতপ্রেমী জনসাধারণের মাঝেও গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছিল। আবির্ভাবের পর থেকেই গজল এ উপমহাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের নানা ধাপ পেরিয়ে এখন অনন্যভাবে স্থায়ী এক ফর্ম হিসেবে গণ্য হচ্ছে। উপমহাদেশের কবিতার বা সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে গজলের প্রসঙ্গ বাদ দেয়ার কথা সম্ভবত ভুলেও কোনো গবেষক-লেখক ভাবতে পারবেন না। মানব-মানবীর চিরায়ত অন্তরের হাহাকার এমন জনবোধ্যরূপে উর্দু গজলের মতো আর কি কোথাও মেলে?
পশ্চিমা কবিদের গজলপ্রীতি
আশ্চর্যের বিষয় এই, পাশ্চাত্য দুনিয়ার কোনো সাহিত্যে গজল বা গজলের সঙ্গে তুলনীয় কোনো নির্দিষ্ট সাহিত্যিক ফর্ম না থাকা সত্ত্বেও তা দীর্ঘকাল ধরে পাশ্চাত্যের একাধিক ভাষার কবিদের আকর্ষণের সামগ্রী বলে গণ্য হচ্ছে। উনিশ শতকে যখন জার্মানি প্রাচ্যের নানা বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছিল, তখনই অর্থাৎ এক লাগসই সময়ে সেখানে পারসিক গজলের অনুবাদ হাজির হয়। সংস্কৃতবিশারদ প্রাচ্যবিদ ফ্রেডরিক স্নেগাল গজলের ধরনে কিছু পরীক্ষামূলক লেখা তৈরি করেছিলেন। তার সমসাময়িক মহাকবি গ্যেটে পারসিক মডেল অনুসরণ করে গজল লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিছু অনুবাদও করেছিলেন। যেগুলো পরে তার কাব্যসংকলন West-ostliche Divan-এ সংকলিত হয়েছিল। আরেক প্রাচ্যবিদ ফ্রেডরিক রিকার্ট হাফিজের গজলের অনুকরণে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে Ghaselen নামের এক কাব্যসংকলন ছাপিয়েছিলেন। অগস্ট গ্রাফ ভন প্লাতেন নামের এক জার্মান বহুভাষাবিদ আবার অনুকরণের পথে না গিয়ে পারসিক গজলের ছন্দ ও অন্ত্যমিল রীতিমতো মেনে গজল লেখার চেষ্টা করেছিলেন। তার লেখা দুটি গজলের সংকলন প্রকাশও পেয়েছিল। বিশ শতকে এসে স্পেনীয় কবি ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা একাধিক গজল লিখেছিলেন gecelos শিরোনামের অধীনে। পরে সেগুলো তার কাব্যগ্রন্থ দিওয়ান ডেল তামারিত-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এ কাব্যগ্রন্থ লোরকার গজলপ্রীতি ও আরব-আন্দালুসীয় মিশ্র সংস্কৃতির প্রতি তার অনুরাগের অনুপম নিদর্শন নিঃসন্দেহে।
শুধু জার্মানই অবশ্য নয়, অন্যান্য পশ্চিমা ভাষায়ও গজল রচনা ও অনুবাদের ঝোঁক দেখা গিয়েছে। যেমন ইতালিয়ান, ইংরেজি ও ফরাসি। এসব ভাষায় গজলের অনুবাদ ও ভাবানুকরণের পাশাপাশি মৌলিক গজল লেখার একটি প্রবণতাও নজরে পড়ে। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে ইংরেজিভাষী পরিমণ্ডলে গজল বড় রকমের গ্রহণযোগ্যতার দেখা পায়। বহু তরুণ কবিই তখন গজলের ফর্মে কবিতা লেখার চেষ্টা করছিলেন, ইংরেজি সাহিত্যের পরিমণ্ডলে গজলকে জনপ্রিয় করে তুলছিলেন। মার্কিন মুলুকে আড্রিয়ান রিচ, জন হল্যান্ডার ও রবার্ট ব্লাই; কানাডায় জিম হ্যারিসন, ফিলিস ওয়েব ও ডগলাস বার্বার এবং অস্ট্রেলিয়ায় জুডিথ রাইটের নাম এক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য (তবে আরো অনেকের নামই বাদ পড়ে গেল)। তারা মূলত গজলচর্চা করছিলেন কাব্যসাহিত্যের ধারায় ভিন্ন রকম কিছু যোগ করার ইচ্ছায়। আড্রিয়ান রিচের কথাই ধরা যাক; ১৯৬৯ সালে মির্জা গালিবের মৃত্যুশতবার্ষিকীর সময় তিনি প্রথম গালিবের গজলের সঙ্গে পরিচিত হন। তখন গালিবের গজল অনুবাদ করতে গিয়ে দ্রুতই তিনি এর প্রেমে মশগুল হন। পরে তিনি ‘গালিবের প্রতি শ্রদ্ধালেখন’ শিরোনামে ১৭টি গজল (নির্দিষ্ট গড়ন ও আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে) লিখে আলাদা আলাদা লিফলেট আকারে ছাপিয়েছিলেন। পরে তার কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় এ গজল লেখার প্রবণতা বিষয়ে আড্রিয়ান রিচ জানিয়েছিলেন, ‘আমার গজলগুলো একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন, মার্কিন ও একুশ শতকীয়; কিন্তু তারা আমার মনে যে গালিবের আনাগোনা, তার কাছে যারপরনাই ঋণী।’
পশ্চিমের তরুণ কবিরা কেন ওই সময় নতুন কাব্যভাষা ও অনুভব প্রকাশের উদ্দেশ্যে গজলের ফর্মকেই আরাধ্য করেছিলেন? কাব্যকলার এ অভিবাসী ফর্মকে নিজেদের ভাষায় আত্তীকরণ করলে কবিতা শিল্পের সমৃদ্ধি ভিন্নতর মাত্রায় উত্তীর্ণ হবে এবং এমন সব অনুভবের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব হবে, যেগুলো কিনা পাশ্চাত্যের প্রচলিত একাধিক ফর্ম দ্বারা তখন অবধি তুলে আনা যাচ্ছিল না—সম্ভবত এমনটিই ছিল তাদের ধারণা। পশ্চিমা ঐতিহ্যে যেসব অনুভব-অভিজ্ঞতা স্পষ্টরূপে অনুপস্থিত, সেই ‘অধরা মাধুরী’কে ধরার জন্য গজল তাদের কাব্যিক তত্পরতার অন্যতম কার্যকারী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। তবে তারা ইংরেজিতে গজলকে স্থায়ী ও অভিনবরূপ দিতে পারেননি। পরে এ কাজে অবশ্য কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি আগা শহিদ আলি সফল হয়েছিলেন। তিনি মৌলিক গজলই লিখেছিলেন, অনুবাদ-ভাবানুবাদের পথে হাঁটেননি। কিন্তু গজল লেখার প্রচলিত ছন্দ ও বিন্যাসকে তিনি পরিত্যাগ করেননি। তার গজলের অনুভব নতুন, কিন্তু কাঠামোটি চিরায়ত। যারা গজলের নামে ‘ফ্রি ভার্স’ কবিতা লিখতে চেয়েছেন, তাদের সম্পর্কে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে গেছেন। আগা শহিদ আলি মনে করতেন, কেউ যদি ‘প্রকৃত’ গজল লিখতে চায়, তবে এমনটা করা নেহাতই স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড। ‘ফ্রি ভার্স’ গজল লিখতে চাওয়া কবিদের প্রচেষ্টাকে ‘হাস্যকর’ মনে করা ও শুদ্ধতার সাধনায় একাগ্র আগা শহিদ আলি তাই নিজের গজল সংকলন Call Me Ishmael Tonight ও সম্পাদিত গ্রন্থ Ravishing Disunities: Real Ghazals in English-এ বেশকিছু ‘আদর্শ’ গজলের নমুনা উপস্থাপন করে গিয়েছিলেন।
হাজারো খোয়ায়িশে অ্যাইসি : দি ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব উর্দু গজলস গ্রন্থের লেখক আনিসুর রহমানের রচনা অবলম্বনে
মুহিত হাসান: নন-ফিকশন লেখক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন