হাকালুকি হাওড়

বিলীন হয়ে পড়েছে ২১টি বিল

সাইদ শাহীন ও আফরোজ আহমদ

হাকালুকি হাওড়ের টইটম্বুর রূপ দেখেছেন মৌলভীবাজারে কুলাউড়ার ভুকশিমইল এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই। এককালে হাওড়ের বিলাইয়া বিল, বইশমারা বিল পানিতে পূর্ণ থাকত সবসময়। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। পাখির আনাগোনাও ছিল অনেক।

হাকালুকির সেই রূপ এখন আর নেই। ক্রমেই ভরাট হতে হতে এখন শুকনো মাঠের আকার ধারণ করেছে হাওড়ের বেশকিছু বিল। স্থানীয় বাসিন্দারা মহিষ চরাচ্ছে সেখানে। আবাদ হচ্ছে ধান।

ভুকশিমইল ইউনিয়নের গৌড়করণ গ্রামের আলতাফ মিয়া বলেন, বর্ষায় এসব বিল এলাকা পানিতে পূর্ণ থাকে। তবে শুকনো মৌসুমে বিলগুলোকে আর বিল মনে হয় না। তলদেশে পলি পড়ে হাওড়ের খাল-বিল ভরাট হচ্ছে ক্রমেই। স্থানীয়রা গরু-মহিষ চরায়। বিলের প্রচুর জায়গা দখল করে অনেকে ফসলও ফলাচ্ছেন।

দেশের বৃহত্তম হাওড় হাকালুকির অবস্থান সিলেট ও মৌলভীবাজারে। প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের এ হাওড়সংলগ্ন এলাকা বর্ষাকালে প্লাবিত হয়ে বিশাল জলরাশির রূপ ধারণ করে। এ সময় পানির গভীরতা হয় দুই থেকে ছয় মিটার। হাওড়ের আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৭০০ হেক্টরে। এ হাওড় অঞ্চলের ৮০ শতাংশ মৌলভীবাজারে ও ২০ শতাংশ সিলেটে। হাওড়ে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ২৩৮টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার অংশে ২০০টি। বাকি ৩৮টি সিলেট জেলায়।

মৌলভীবাজার জেলা মত্স্য বিভাগ জানায়, হাওড়ের ২১টি বিল এরই মধ্যে সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে বিলীন হয়ে পড়েছে। কোনোরকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে ২১৭টি। অধিকাংশ বিলই আংশিক ভরাট হয়ে পড়েছে। দ্রুত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া না হলে এসব খাল ও বিলের বড় অংশ শিগগিরই ভরাট হয়ে যেতে পারে।

হাওড়ের ভরাট হয়ে পড়া বিলগুলোর মধ্যে রয়েছে কুলাউড়ার বিলাইয়া বিল, হিংলি বিল, ফুটি বিল, বইশমারা বিল, ডুলা বিল, পিংলারকোনা, তেকুনি বিল, পাওল বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল। এছাড়া ভরাট হয়ে পড়েছে বড়লেখা উপজেলার বিল মালাম, ফুয়ালা, জল্লা, বালিজুড়ি, মাইসলা বিল, হাওড় খাল ইত্যাদি।

জানা গেছে, হাকালুকি হাওড়ের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো ১০টি ছোট-বড় নদী। এ জলরাশি হাওড়ের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীগুলোর উৎস পাহাড় থেকে। প্রতি বছর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রচুর পলি আসে হাওড়ে। ড্রেজিংয়ের অভাবে এসব পলি জমে বিলগুলো ভরাট হয়ে পড়ছে। নদীগুলো পরিণত হচ্ছে খালে। নদীগুলোর মধ্যে বর্তমানে টিকে আছে মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার জুড়ি নদী ও কণ্ঠিনালা। কুলাউড়ায় টিকে আছে ফানাই নদী। বড়লেখায় আছে সুনাই নদী। বাকিগুলোর মধ্যে মরা জুড়ি, নিকড়ি, ষাটমা নদী, বরুদল, বিলাম ইত্যাদি নদী পরিণত হয়েছে ছোট খালে।

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর ও সেন্টার ফর ন্যাচারাল স্টাডিজ (সিএনআরএস) ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হাকালুকিতে যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ওই প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্যমতে, একসময় এ হাওড় অঞ্চল ঘিরে ছিল ছোট-বড় ৩০০টি ছড়া ও খাল-বিল। বর্তমানে ৮১টি ছড়ার প্রবাহ টিকে রয়েছে। বাকিগুলো বিলীন হয়েছে। বিলীন হওয়া ছড়া-খালের মধ্যে সারির খাল, চান্দর খাল, গোগালী ছড়া, কচমার খাল, লামাই লঙ্গির খাল, জামলার খাল, কাটুয়া খাল, পনার খাল উল্লেখযোগ্য। 

হাকালুকি হাওড়ের বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে জলজ বন। বিভিন্ন ধরনের জলজ ভাসমান, শেকড়ধারী, ঔষধি ও অতিরিক্ত জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ জন্মায় এ অঞ্চলে। হাওড়ের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর মধ্যে হিজল, করচ, বরুণ, বনতুলসী, নলখাগড়া, পানিফল, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্ভিদ নিয়ে গড়ে ওঠা বনরাজি বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির আবাসস্থল। সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং খাল-বিল-ছড়া ভরাট ও দখলের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে বনের জীববৈচিত্র্য। ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও সরীসৃপ এখন বিলুপ্তপ্রায়। আগে এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত। এখন আর আসে না।

মরে যাওয়া হাওড় খালের স্মৃতি সাদিপুর গ্রামের মত্স্যজীবী বাদল মিয়াকে বেশ ভারাক্রান্ত করে তোলে এখন। তিনি জানালেন, মরে যাওয়া হাওড় খালে আগে নৌকা চলত। মাছ ধরা হতো। এখন ধান চাষ হয়। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও আগের মতো আর নেই। অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে। হাওড়-খাল ভরাট হওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন মত্স্যজীবীরা। বর্ষার ভাসান পানিতে আগের মতো আর মাছ জন্মায় না। শুষ্ক মৌসুমে বিলগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে দিন দিন মাছ কমছে। এতে বিপদে পড়ে গেছেন হাওড়পাড়ের জেলেরা।

বাংলাদেশের প্রধান চারটি মাদার ফিশারিজ এলাকার একটি হাকালুকি হাওড়। জেলা মত্স্য বিভাগ জানিয়েছে, মৌলভীবাজারে মাছের বার্ষিক চাহিদা ৪৩ হাজার টন। এর মধ্যে ১৪ হাজার টন উৎপাদন হয় হাকালুকিতে। বিল ভরাটের কারণে মাছ উৎপাদন কমছে। তবে উৎপাদন বাড়াতে বিল নার্সারি স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে হাকালুকিতে মাছের অভয়াশ্রম আছে ১৫টি। এর পরও হাওড়ে ১৫০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে বর্তমানে টিকে আছে ১১২টি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মৌলভীবাজারের সভাপতি আ স ম সালেহ সোহেল বণিক বার্তাকে বলেন, হাকালুকি হাওড়কে মিঠাপানির অন্যতম প্রজনন কেন্দ্র বলা হয়। বাংলাদেশে জলজ উদ্ভিদ প্রজাতির অর্ধেকেরও বেশি হাকালুকি হাওড়ে জন্মে। হাওড়তীরের প্রায় দুই লাখ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ হাওড়ের ওপর নির্ভরশীল। খাল ও বিল ভরাটের পাশাপাশি নদী এভাবে ভরাট-দখল হয়ে যাওয়ার কারণে হুমকিতে পড়বে হাকালুকি হাওড়ের জীববৈচিত্র্য। এখনই ব্যবস্থা না নিলে প্রাণ প্রতিবেশ বেশিদিন টিকবে না।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সম্প্রতি হাকালুকি হাওড়ের বিল ও ছড়া ভরাট-দখলের বিষয়টি নজরে আনেন। মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, পাহাড়-টিলা এখন আর মাটি সেভাবে ধরে রাখতে পারছে না, যার কারণে পলিতে ভরে যাচ্ছে হাওড়ের নদী। হাকালুকি হাওড়ের খাল-বিল-ছড়াগুলো ভরাট হয়ে পড়ছে। মনু নদের তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। এগুলো খননের ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন