অর্থ ও বাণিজ্যিক স্থাপনার অপচয় ঘটাচ্ছে এটিএম বুথ

হাছান আদনান

ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক। মহীপাল থেকে ট্রাংক রোড পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটারের এ সড়কে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা আছে ৩৩টি। এটিএম বুথ আছে ২৭টি। সড়কটির দুই পাশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোর বেশির ভাগই কোনো না কোনো ব্যাংকের দখলে। প্রায় একই পরিস্থিতি কুষ্টিয়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ এনএস রোডেরও।

ব্যতিক্রম নয় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোও। ব্যস্ততম কারওয়ান বাজার এলাকার বেশির ভাগ ভবনেই আছে কোনো না কোনো ব্যাংকের শাখা। প্রায় সব ভবনের নিচেই আছে এটিএম বুথ। জিগাতলার সীমান্ত স্কয়ারের আশপাশে এটিএম বুথ স্থাপন করেছে অন্তত ১৫টি ব্যাংক। একই চিত্র রাজধানীর অন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও ভবনেরও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ৫৯টি ব্যাংকের মধ্যে এটিএম বুথভিত্তিক সেবা দিচ্ছে ৫১টি ব্যাংক। তথ্যমতে, গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশে সবগুলো ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৭২২। স্থাপিত এটিএম বুথগুলোর সিংহভাগই রাজধানীসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন এবং জেলা শহরে সীমাবদ্ধ। এসব শহরাঞ্চলের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর প্রায় সবখানেই এটিএম বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের অর্থের অপচয় বাড়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক স্থাপনার জায়গাও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিকেন্দ্রীভূত নগরায়ণের মাত্রা চাহিদার তুলনায় একেবারেই যৎসামান্য। এ কারণে জেলা শহরগুলোয় বাণিজ্যিক স্থাপনার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। অন্যদিকে ব্যাংকের সংখ্যা হয়ে গেছে অনেক বেশি। ফলে অনেক শহরেই দেখা যায়, এক ভবনেই শাখা খুলে বসেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। একই পরিস্থিতি এটিএম বুথের ক্ষেত্রেও। অনেক ব্যাংকের এটিএম বুথে সারা দিনে ১০টিও লেনদেন হয় না। আবার অনেক এলাকায় বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও কোনো ব্যাংকেরই এটিএম বুথ নেই। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য এটিএম বুথ সেবাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পৃথক কোম্পানি গঠনের দাবি তুলেছেন তারা।

এটিএম বুথ সেবাকে তৃতীয় কোনো কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া দরকার বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, পৃথিবীর বহু দেশেই এটিএম বুথ সেবাটি পৃথক কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি এখন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। এটিএম সেবা প্রদানের জন্য একটি বা দুটি কোম্পানি গড়ে উঠলে ব্যাংকগুলোর ব্যয় অনেক কমে আসবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক স্থানের অপব্যয় কমার পাশাপাশি গ্রাহকরাও প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা পাবেন। কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা সব ব্যাংকের সম্মিলিত উদ্যোগে এ ধরনের কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে।

দেশের এটিএম বুথগুলোর প্রায় অর্ধেক ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের জেলা শহরগুলোর একই রাস্তায় একাধিক এটিএম বুথ আছে ব্যাংকটির। ফাস্ট ট্র্যাক নামেও পৃথক ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। যদিও বিভিন্ন উৎসবসহ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যাংকটির এটিএম বুথে টাকা না পাওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো। একই অভিযোগ রয়েছে দেশের অন্য ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও।

ব্যাংকগুলোর নিজস্ব এটিএম বুথ থেকে বিনা ফিতে গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারেন। কিন্তু এক ব্যাংকের গ্রাহক অন্য ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে প্রতি লেনদেনে ১০-১৬ টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয়। কোনো গ্রাহককে দিনের সর্বোচ্চ লেনদেনসীমা ৫০ হাজার টাকা তুলতে লেনদেন করতে হয় তিনবার। এজন্য ফিও গুনতে হয় তিন গুণ।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের অনেক ব্যাংকের এটিএম বুথে সারাদিন মিলিয়ে ১০ জন গ্রাহকও আসে না। কোনো কোনো ব্যাংকের এটিএম বুথের পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ।

সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এটিএম বুথে খোঁজ নিলে নিরাপত্তারক্ষী জানান, সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টাকা তুলতে এসেছিলেন মাত্র দুজন গ্রাহক।

মতিঝিলে অবস্থিত দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তারক্ষী জানান, এটিএম বুথটি মাসের অর্ধেক সময়ই অকার্যকর থাকে। মাঝে মধ্যে গ্রাহকরা টাকা তুলতে এলেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।

বিশৃঙ্খল এ পরিস্থিতিকে সহজেই সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথ সেবাকে আউটসোর্সিং কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া প্রয়োজন। এটিএম বুথ স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকারদের অনেক সময় ও শ্রম দিতে হয়। এটি করতে গিয়ে ব্যাংকারদের মৌলিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এটিএম বুথ সেবাটিও নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। যেকোনো ব্যাংকের গ্রাহক একই বুথ থেকে টাকা তুলতে পারলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এটিএম বুথ ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।

যেকোনো স্থানে একটি এটিএম বুথ স্থাপন করতে হলে তার জন্য ভবন ভাড়া করতে হয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ভবন বা এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকেই এটিএম বুথ স্থাপনের জন্য নির্বাচন করে থাকে ব্যাংকগুলো। এজন্য প্রতিটি এটিএম বুথ স্থাপনে খরচ হয় ১০-১৫ লাখ টাকা। প্রতিটি এটিএম বুথের জন্য দায়িত্ব পালন করে ন্যূনতম দুজন নিরাপত্তারক্ষী। তাদের বেতন-ভাতাসহ জায়গা ভাড়া, বিদ্যুিবল ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে একটি এটিএম বুথের পেছনে ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসে ব্যয় করতে হয় গড়ে ৪০ হাজার টাকার বেশি। সেবাটিকে অন্য কোনো কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিলে ব্যাংকের ব্যয় অনেক কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের ভাষ্যমতে, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই এটিএম সেবা পুরোপুরি তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশেও এটি হওয়া দরকার।

এটিএম বুথ সেবাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, এটিএম সেবাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। নতুন নীতিমালায় বুথ স্থাপনের জন্য শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলকে প্রাধান্য দেয়া হবে। এছাড়া এটিএম সেবাটি তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য কোম্পানি গঠনের অনুমোদনও দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালার আওতায় লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে একটি কোম্পানি আবেদন করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন