গতিশীলতার খোঁজে

পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাণিজ্য সুরক্ষায় করণীয়

রঘুরাম রাজন

গত দশকের শেষের দিক থেকে বিশ্বায়নআন্তঃসীমান্ত পণ্য, সেবা, বিনিয়োগ তথ্যপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা প্রশমনের প্রক্রিয়া-ভয়াবহ চাপের মুখে পড়েছে। অনেক দেশের লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপকর্ম বা ভুল কাজের জন্য একে অন্যকে অভিযুক্ত করেছেন এবং বাণিজ্য চুক্তিগুলো পুনর্লিখনে চাপ সৃষ্টি করেছেন। কয়েক দশক ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলো তর্ক করে আসছে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার নীতিগুলো গভীরভাবে অন্যায্য। কিন্তু এখন কেন একই ধরনের অভিযোগ উন্নত দেশগুলোর দিক থেকে উত্থাপিত হচ্ছে, যেসব নীতির বেশির ভাগই তৈরি করেছে তারা?

এর একটি সরলসিধা অথচ অপর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হলো, ‘প্রতিযোগিতা ১৯৬০ ১৯৭০-এর দশকে শিল্পায়িত দেশগুলো তাদের পণ্যের জন্য বিদেশী বাজার উন্মুক্তকরণের ওপর মনোযোগ দিয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী নীতি ঠিক করেছিল। তখন থেকেই বাণিজ্য জোয়ারের মোড় ঘুরেছে। উদীয়মান অর্থনীতিগুলো, বিশেষ করে চীন পণ্য উৎপাদনে অনেক ভালো করেছে এবং বিশ্বের সব জায়গার অধিক উৎপাদনক্ষম উৎপাদকদের জন্য সমকালীন পর্বে নিজেদের বাজারকে অত্যাবশ্যকভাবে খোলা রাখার উন্নত দেশগুলোর পুরনো নীতিগুলোকে পথনির্দেশ করেছে।  

একজন নৈরাশ্যবাদী-সংশয়ী পর্যবেক্ষকের কাছে নীতিগুলো পুনর্লিখনে উন্নত দেশগুলোর বর্তমান প্রচেষ্টা সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি নয়, প্রতিযোগিতা ব্যাহত করার চেষ্টার মতোই। উদীয়মান বাজারের উৎপাদকরা কেন বেশি প্রতিযোগীসক্ষম, এর একটি কারণ হলো, তারা কর্মীদের মজুরি কম দেয় (কেননা সাধারণত ওইসব কর্মী কম উৎপাদনশীল) কাজেই অন্তত ঘণ্টায় ১৬ ডলার (২০২৩ সাল নাগাদ) উপার্জনকারী কর্মীদের দ্বারা ৪০-৪৫ শতাংশ গাড়ির যন্ত্রাংশ (অটোমোবাইল কম্পোনেন্ট) তৈরির শর্ত জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি (ইউএসএমসিএ, পুনঃআলোচিত নাফটা) মেক্সিকোর আপেক্ষিক সুবিধা সীমায়িত করবে। শক্তিশালী ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাসহ এটি মেক্সিকান কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের শ্রম সুরক্ষার এখতিয়ার দেয়, তবে সেসব বিষয় তদারক করা হবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিদর্শকদের দ্বারা। সহানুভূতিশীল-দরদি মার্কিন আলোচকদের দ্বারা আরোপিত চুক্তি ভালো মনে হলেও এটিকে মেক্সিকোতে উৎপাদন খাতের কর্মসংস্থান (ম্যানুফ্যাকচারিং জব) সীমায়িত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

কিন্তু কয়েক দশক ধরে উৎপাদন খাতের কর্মসংস্থান-চাকরি উদীয়মান বাজারগুলোর দিকে যাত্রা করে আসছে, তাহলে এখন কেন উদ্বেগ বেড়েছে? উৎপাদন খাতের হারানো কর্মসংস্থান প্রতিস্থাপনে উন্নত অর্থনীতিগুলো কম প্রযুক্তির ডেলিভারি থেকে শুরু করে উচ্চ প্রযুক্তির গবেষণা উন্নয়নসহ (আরঅ্যান্ডডি) সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আসছে। যে অন্তর্নিহিত বা পরোক্ষ চুক্তি-দরকষাকষি বাণিজ্য পরিচালনা করেছিল, সেটি হলো উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উৎপাদন খাতের পণ্য রফতানির জন্য উন্নত দেশগুলো নিজেদের বাজার খোলা রাখবে, বিপরীতক্রমে যা শিল্পায়িত দেশগুলো থেকে সেবা রফতানির জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

দুর্ভাগ্যক্রমে উন্নত দেশগুলোর সব নাগরিক সেবা খাতের ভালো চাকরিগুলোয় স্থানান্তর করতে সমর্থ হয়নি। খাতের সর্বোত্তম চাকরিগুলো প্রধানত বড় শহরগুলোয়, যেখানে সুশিক্ষিত পেশাজীবীরা বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পেরেছেন, যদিও আমেরিকান মিডওয়েস্ট এবং নর্দান ইংল্যান্ডের মতো ছোট শহরগুলো উৎপাদন খাতের বৃহৎ নিয়োগকারীদের (এমপ্লয়ার) প্রস্থানজনিত অভিঘাত থেকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উল্লিখিত এলাকাগুলোর বিপর্যয় এবং সেখানকার বাসিন্দাদের হতাশা চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকে শক্তি জুগিয়েছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোককে প্রেসিডেন্ট হতে সহায়তা করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়াকে উসকে দিয়েছে। পিছিয়ে পড়া সাবেক ম্যানুফ্যাকচারিং কমিউনিটিগুলো এখন রাজধানী শহরে দৃঢ় একটি বক্তব্য প্রকাশ করছে এবং তারা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।

তবে তাদের কথাবার্তা ব্যাখ্যাও অসম্পূর্ণ। উদাহরণ দেয়া যাক। যেমন চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যবিরোধের অনেকটাই ম্যানুফ্যাকচারিং (চীন ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোয় নিজেও ম্যানুফ্যাকচারিং জব হারাচ্ছে) নয়, সেবা খাত সম্পর্কিত। যদিও শীর্ষ সেবা রফতানিকারকের আটটিই উন্নত দেশগুলো, তবু উদীয়মান বাজারের প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং প্রাগ্রসর অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক নতুন সেবা-সম্পর্কিত বাণিজ্য নীতিগুলো বলবত্করণে একটি বড় ধরনের চাপ ত্বরান্বিত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি সেবার জন্য সীমান্ত খোলা রাখা নিশ্চিত করবে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি প্রভাবশালী উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদকদের সুবিধা সুরক্ষার সুযোগও দেবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউএসএমসিএ গান -বুকের মতো অনলাইন মাধ্যমে কেনা পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক আরোপের এখতিয়ার দেয় না এবং এটি নিশ্চিত করে যে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের পণ্যের কনটেন্টের জন্য দায়ী নয়। এটি কিছু ওষুধের পেটেন্ট সুরক্ষার মেয়াদ সম্প্রসারণের জন্যও একটি ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিল। তবে কংগ্রেসনাল ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ উপস্থাপন করায় ধারাটি বাদ দেয়া হয়েছিল।  

উদীয়মান বাজারের অভিজাতরা পরিবর্তিত বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য সুরক্ষায় নিজস্ব উপায়ে, নিজেদের মতো করে সাড়া দিচ্ছে। রিলায়েন্স (বড় ইন্ডিয়ান কনগ্লোমারেট) তাদের নিজস্ব -কমার্স প্লাটফর্ম চালুর ঠিক আগে ভারত অ্যামাজন ওয়ালমার্টের মতো বিদেশী মালিকানাধীন প্লাটফর্মগুলো সীমায়িত করতে নতুন নীতি প্রবর্তন করেছে।

মোদ্দাকথা, দুটি ফ্যাক্টর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিয়োগ ব্যবস্থার অস্বস্তি বাড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলোর পেছনে পড়ে থাকা সম্প্রদায়গুলোর সাধারণ মানুষ আর বিদ্যমান ব্যবস্থা মানতে-গ্রহণে ইচ্ছুক নয়। তারা নিজেদের কথা শুনতে চায় এবং তারা চায় তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হোক। পুরনো স্থিতাবস্থা যেখানে নিজেদের সেবা বাজার সম্প্রসারণের জন্য উন্নত দেশগুলোর অভিজাতরা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের অফশোরিংয়ের প্রতি অন্ধ ছিলঅচল হয়ে পড়েছে, অসমর্থনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি একটি ফ্যাক্টর অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতির অভিজাতরা সেবার জন্য বৈশ্বিক বাজারের একটি অংশ সহভাগ করতে চায় এবং তারা আর সেখানে নিজেদের ভিত্তি ছেড়ে দিতে বা হারাতে ইচ্ছুক নয়।  

ফলে সেখানে আর কোনো সহজ বাণিজ্য চুক্তি নেই। প্ররোচনা নয়, ক্ষমতার রাজনীতিতে বাণিজ্য আলোচনা নৈমিত্তিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। এর বড় উদাহরণ, বাজার বন্ধে আকাশচুম্বী শুল্ক আরোপের হুমকি এবং দুর্বল পক্ষের ওপর তথাকথিতন্যায্যনীতি কার্যকরে শক্তি প্রয়োগের প্রচেষ্টা। বাণিজ্য আলোচনার অভিজ্ঞরা বলতে পারেন যে বিষয়টি সবসময়ই তো এভাবে হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, উদীয়মান বাজারগুলোর জনগণ আগের (পড়ুন অতীতের) চেয়ে গণতান্ত্রিকভাবে বেশি যুক্ত। যখন মেক্সিকান বিজনেস চেম্বারের প্রধান ইউএসএমসিএর শ্রম তদারকি বিধান ১৯৪৮ সালের মেক্সিকো-আমেরিকার যুদ্ধের (যখন মেক্সিকো ক্যালিফোর্নিয়াকে হারিয়েছিল) সঙ্গে তুলনা করবে, তখন মেক্সিকান ভোটাররা তার কথা শুনতে পারে। 

অতএব, আজকে ধনী দেশগুলোর অন্যদের জন্য পীড়নকর নীতি প্রয়োগের যেকোনো সফলতা অনেক চড়া মূল্যের প্রমাণ হতে পারে। একটি বিষয় অস্পষ্ট যে এমনকি উন্নত দেশগুলোয়ও এসব নীতি সম্পর্কে কোনো ঐকমত্য আছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, কনটেন্টের জন্য অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে দায়ী করতে যুক্তরাষ্ট্রে একটি অব্যাহত চাপ আছে। বাণিজ্য চুক্তিগুলোয় এসব বিতর্কিত নীতি অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেগুলো ওইসব চুক্তিকে অধিক নাজুক ভঙ্গুর করে তুলবে। অধিকন্তু, এসব চুক্তি একটি খারাপ নজির স্থাপন করবে। ভবিষ্যতে বিশ্বের প্রভাবশালী ভোক্তারা হবে সম্পদশালী, তরুণ এবং বলা বাহুল্য, তারা উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর অধিকসংখ্যক নাগরিক। এখন যারা অসুবিধাজনক ব্যবস্থায় দুর্বল দেশগুলোকে চাপে রাখছে, তাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না যে কোনো একদিন এটি তাদের ঘাড়েও চাপতে পারে।

বাণিজ্যকে অধিকতর ন্যায্য করতে তাহলে কীভাবে উন্নত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাপের প্রতি সাড়া দেয়া উচিত? উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিম্ন শুল্ক ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য রীতিতে পরিণত করার দাবি স্টার্টারদের জন্য যুক্তিসংগত হবে। একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক অশুল্ক বাধা কিংবা নিজেদের উৎপাদকদের অনুকূল ভর্তুকিগুলো সম্পর্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। তবে এসব পদক্ষেপের বেশি যাওয়াইউনিয়নের ওপর প্রাধিকার আরোপের চেষ্টা করা, অনলাইন প্লাটফর্মগুলো এবং অন্য দেশগুলোর ওপর পেটেন্টের সময়সীমার নিয়ন্ত্রণবাণিজ্যবিষয়ক ঐকমত্যকে আরো অবমূল্যায়ন করবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে আজকের কম অনধিকারচর্চামূলক বাণিজ্য চুক্তিগুলো আগামীর বাণিজ্যের জন্য অধিক কিছু করতে পারে। আমাদের সেভাবেই এগোতে হবে বৈকি। 

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

রঘুরাম রাজন: রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর, শিকাগো বুথ স্কুল অব বিজনেসের ফিন্যান্সের অধ্যাপক এবংদ্য থার্ড পিলার: হাও মার্কেটস এবং দ্য স্টেট লিভ দ্য কমিউনিটি বিহাইন্ডগ্রন্থের লেখক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন