সাম্প্রতিক

মিত্র বদল আর মধ্যপ্রাচ্যের বিরতিহীন যুদ্ধ

রাহুল আনজুম

প্রায় শতবর্ষ আগে অটোম্যানদের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে অশেষ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, তার সমকালীন সংস্করণ এখন বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপিত। শতবর্ষের সুরাহাহীন যুদ্ধের সুরাহার আশা যে নিকট ভবিষ্যতে বোকামি, তার সর্বশেষ নমুনা সিরিয়ার অভ্যন্তরে তুরস্কেরঅপারেশন পিস স্প্রিং, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ আর সৌদি বলয়ের মদদে পশ্চিমাদের ইরান অভিযান। আশাহীনতার কারণ, বড় দাগে আরবরা আর মধ্যপ্রাচ্যের মানুষজন যুদ্ধের বিধায়ক নয়, বরং নীরব দর্শক। বিধায়করা নানা সময়ে মিত্র পরিবর্তন করে কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখে। খেলোয়াড়রা বিধায়কের মিত্র পরিবর্তনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

যখনই বিধায়কের মিত্র পরিবর্তন দরকার, সেটা রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক কারণেই হোক, তখনই বিধায়করা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের দফাদার বনে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর করে হাঙ্গামার আয়োজন করে। নির্দিষ্ট গতিতে বিধায়কের তত্ত্বাবধানে হাঙ্গামার আয়োজন চলতে থাকে। আশির দশকে আয়োজনে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সাদ্দাম হোসেন, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের দফাদার বনে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ওই ভূমিকায় ছিলেন এরদোগান এবং সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের বিরাগভাজন এরদোগান-পরবর্তী সময়ে ঝাণ্ডা এখন হালের নব্য বিপ্লবী কুর্দিদের হাতে। দফাদার বনে যাওয়ার পরম আবেগ আর পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আয়োজনে সাদ্দাম হোসেন ১০ বছরব্যাপী যুদ্ধ করেছেন ইরানের বিরুদ্ধে। যুদ্ধেই ক্ষান্ত দেননি সাদ্দাম হোসেন। কুর্দি নিধনসহ সর্বশেষ উপসাগরীয় যুদ্ধ বাধিয়ে পশ্চিমা বিধায়কদের স্থায়ী ঘাঁটি করার সুযোগ করে দেন মধ্যপ্রাচ্যে। শুরুর দিকে এরদোগান অনেকটা সতর্কভাবে এগোলেও মোটা দাগে সিরিয়ার অশেষ যুদ্ধের চোরাবালিতে আটকে অনেকটা টালমাটাল এরদোগান। দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে বেহাল এরদোগানের নতুন যুদ্ধযাত্রা হয়েছে লিবিয়ায়। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, হালের নব্য কুর্দিরা পশ্চিমাদের কাছে নিজেদের একনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রমাণ করতে সফল হয়েছে। পশ্চিমাদের নতুন মিত্রের উপস্থিতি শুরুর দিকে সৌদির অস্থিরতার কারণ হলেও বৃহৎ স্বার্থ দেখে সৌদিরা পশ্চিমাদের এই নতুন মিত্রে আস্থা রাখছে, তুরস্ককে দমানোর আশায়। তবে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে কুর্দিদের রাজনৈতিক শক্তির ওপর ভর করে আর আস্থা রেখেই আগামীর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রের অঙ্কন করবে বিধায়করা।

প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পশ্চিমা ধাঁচের জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন কুর্দিদেরসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম নিষিদ্ধ করে যখন তুরস্কের রাষ্ট্রযন্ত্র লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছিল, তখন ন্যাটো সদস্য আর সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তুরস্কের আবশ্যকীয়তা অনুভব করে পশ্চিমা বিধায়করা চুপ ছিল। সাদ্দাম হোসেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে লাখ লাখ কুর্দি হত্যার পর বিধায়ক মার্কিনরা জাতিসংঘের মাধ্যমে দু-একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করেই ক্ষান্ত ছিল। আসাদ এবং তার বাবা হাফেজ আল আসাদ উভয়েই যখন কুর্দিদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন, পশ্চিমারা তখন সমতার গল্প শোনায়নি, যেমনটা শুনিয়েছে ইরাকে হামলা করে। শোষণ আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আশির দশকে যখন কুর্দিদের একটি অংশ পিকেকে নাম ধারণ করে সমাজতন্ত্রকে আদর্শ মেনে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে, তখন পশ্চিমারা তাদের সন্ত্রাসী সংগঠনে তালিকাভুক্ত করেই থামেনি, বরং ইরাক, তুরস্ক আর সিরিয়ার তদানীন্তন সরকারগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর নামে সব সহযোগিতা দিয়ে কুর্দিদের দমন করেছিল। যে দমনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল নিষ্পেষণের এক করুণ ইতিহাস, যা আরব-কুর্দি-তুর্কিদের মধ্যে স্থায়ী বিবাদকে আরো বেশি মজবুতি দিয়েছিল। বিধায়করা অপেক্ষায় ছিল সঠিক সময়ের। ইরাক যুদ্ধ আর তথাকথিত আরব বসন্ত বিধায়কদের আবার মিত্র পরিবর্তন করে নতুন ইতিহাস লেখার সুযোগ করে দেয়। এবারের ইতিহাসে কুর্দিদের নির্মমতার শিকার হচ্ছে ছোট ছোট আরব কুর্দি গোত্র, যারা বিভিন্ন সময়ে সমাজতন্ত্রবাদ আর সশস্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে ছিল।

নিরাপদ বিশ্ব গড়ার নামে আফগান যুদ্ধের পর এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তালেবান, যারা আফগান মুজাহিদীনের একটি অংশ, আর সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিধায়করাসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধেরসূচনা করে। কুর্দিদের সাহায্যে বিধায়করা সহজেই উত্খাত করে এককালের মিত্র সাদ্দামকে। আর ইরাকি কুর্দিরা যুদ্ধে বিধায়কদের পাশে থাকার পুরস্কারস্বরূপ স্বায়ত্তশাসন অঞ্চল লাভ করে। মোটা দাগে কুর্দিরা তাদের দুর্দশার জন্য স্থানীয় আরব সরকারকে দায়ী করলেও পর্দার অন্তরালের বিধায়কদের অবস্থান কখনই পর্যালোচনা করেনি। পর্যালোচনার অক্ষমতা আর ইরাক যুদ্ধে ইরাকি কুর্দিদের অবদানে পশ্চিমা জগৎ কুর্দিদের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা শুরু করে এবং সময়ের পরিবর্তনে সৌদির পাশাপাশি ইরাকি কুর্দিরাও এখন পশ্চিমা বিধায়কদের মিত্র। তবে তুরস্ক আর সিরীয় কুর্দিদের সমাজতন্ত্রে আগ্রহে তাদেরকে অনেকটা উপেক্ষিত করেছিল পশ্চিমা মহলে আইএসের উত্থানের আগ পর্যন্ত।

সচেতন পাঠকরা খেয়াল করলে দেখবেন যে আইএসের উত্থান আর ক্ষিপ্রগতিতে ইরাক আর সিরিয়ায় বিস্তার নিয়ে পশ্চিমা মহলে আলাপের কোনো আগ্রহ নেই। শুধু সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন বলেই পশ্চিমারা এক ধরনের যুক্তি দেখিয়ে ওই সন্ত্রাসের উৎস ঢেকে রাখতে চায়। বিশ্বকে সাদ্দামের পরমাণু মারণাস্ত্র থেকে রক্ষার নামের যুদ্ধ এক বড়সড় রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছিল ইরাকে। যে শূন্যতাকে স্বাস্থ্যবান করেছিল নুরি মালিকি তার উত্তরসূরিদের সীমাহীন দুর্নীতি আর শিয়া-সুন্নি বিরোধ। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক শূন্যতা আইএসের উত্থানের অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়। তবে কোন শক্তিতে পশ্চিমা বিধায়কদের নাকের ডগায় আইএস কামানের গতিতে কীভাবে মধ্যপ্রাচ্য তছনছ করে দিল, তার উত্তর এখনো মেলেনি। নিন্দুকদের ভাষ্যে, ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা, বন্দি নির্যাতন আর নির্বিচারে ইরাকিদের হত্যার কলঙ্ক ঢাকতেই বিধায়কদের পরোক্ষ সম্মতি ছিল আইএসের উত্থানে।

পশ্চিমা বিধায়কদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পিকেকে, ইয়েপেগে তুরস্কের সীমান্ত লাগোয়া সিরিয়ার বিশাল ভূমি দখলে নিয়ে সেমিরাষ্ট্র কায়েম করেছিল, তা তুরস্কের আক্রমণের মুখে অনেকটা নির্বিষ। তুরস্কের অপারেশন পিস স্প্রিং অভিযানে বিধায়করা উভয় দলকেই, তুরস্ক আর কুর্দিদের ইয়েপেগেকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে সর্বশেষ মস্কো আর ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলাপের মধ্য দিয়ে কুর্দিদেরকে তুরস্কের সীমানা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সরে যেতে বলা হয়েছে। তবে সেই সিদ্ধান্ত আসছে ওয়াশিংটন আর মস্কো থেকে; বাগদাদ, এরবিল অথবা দামেস্ক থেকে নয়।

কুর্দিরা হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম স্বর্ণযুগের দেখা পেয়েছে এবং সেটা বিধায়কদের কল্যাণেই। নব্য তুরস্কের শক্তিশালী অবস্থান ঠেকাতে আরবরাও বিশেষ করে সৌদি ব্লক কুর্দিদের পশ্চিমা বিধায়কদের মতোই আশীর্বাদ দিচ্ছে। পিকেকের সহযোগীরা বিধায়কদের নির্দেশে কোনো এক এলাকা দখল করছে হুটহাট করেই, আবার ত্যাগও করছে। পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিনদের মিত্র বদলের খেলা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ইতি টানতে দেবে না, বরং নতুন নতুন হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে। এমনকি মার্কিনরা মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করলে তুর্কি-আরব আর কুর্দিরা অতীত অত্যাচার, নির্যাতন আর নিষ্পেষণের ইতিহাস টেনে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। মধ্যপ্রাচ্য এক অশেষ যুদ্ধের কারখানা।

 

রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন