সংসদে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের তথ্য প্রকাশ

পরিচালকদের ঋণের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আগে ব্যাংক পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন। পরে ওই ঋণ পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যেত, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ বা খেলাপি দেখাতেন। আবার পরিচালকরা পরিচালনা পর্ষদে বসে নিজেরা অনৈতিকভাবে সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের নিজ ব্যাংকের অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো পরিচালক তার মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিজ ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না। অনেক ব্যাংক পরিচালকের শেয়ারের পরিমাণ কম হওয়ায় তারা নিজ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে পারেন না। এরপর থেকেই পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দেন। তখন এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শুরু করেন। এতে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে বেগ পেতে হয়। মোট ঋণের একটি বড় অংশ এখন বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের অধিকারে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ বেড়ে এখন লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে বলে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন।

পরিচালকরা বিনিয়োগের চেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেয়ায় ব্যাংকিং খাত নতুন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ ব্যাংকে যখন পরিচালকের নিজের কোনো বিনিয়োগ থাকবে না, তখন ব্যাংকের প্রতি তার দরদও কম থাকবে। এতে ব্যাংকটি যেকোনো সময় বিপদে পড়তে পারে। এরই মধ্যে আবার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে একসঙ্গে এক পরিবারের চার সদস্যের থাকার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে ব্যাংক পরিচালকরা আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে পারছেন। ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশ বর্তমান সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি হলেও ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অংকের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক। যাদের কয়েকজন বিতর্কিত। তাদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি হয়ে যাওয়ায় ঋণের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংক পরিচালকরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিচ্ছেন, তার বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এভাবে ঋণ নেয়া অনৈতিক সুশাসনের পরিপন্থী। এটা আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এসব অনৈতিক ঋণ নেয়া প্রতিরোধ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে ধরনেরকানেক্টিং লেনদেনবন্ধ করা উচিত। তা না হলে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়।

ব্যাংকঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি। আর খেলাপিরা প্রায় সবাই এলিট শ্রেণীর। তাদের প্রভাব ক্ষমতা রয়েছে। ঋণের সুদের হার (কস্ট অব লেন্ডিং) সবার জন্য এক রকম নয়। একেকজন একেক রেটে ঋণ পাচ্ছেন। প্রতিযোগিতার বাজার প্রায় ধ্বংস হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বাংলাদেশ ব্যাংক) বড় ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেই পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনিয়মের পাহাড় জমেছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি একটু কড়াকড়ি হওয়ায় এখন এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ভিন্ন কৌশলে ঋণ নিচ্ছেন। বিশেষ করে পরিচালকরা ভাগাভাগি করে যে ঋণ নিচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা আর ফেরত আসছে না। এগুলো খেলাপি ঋণ হয়ে যাচ্ছে। আবার মালিকপক্ষের চাপে অসহায় হয়ে অনৈতিক ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা বাড়ছে। ব্যাংকিং ব্যবসা সম্পূর্ণ আস্থার ওপর নির্ভরশীল। আস্থা ফেরাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।

দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বড় অংশই বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক। আইনি নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। ফলে পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে নিজেরা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এসব ঋণের বড় অংশই খেলাপি হলেও তা আদায়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এসব পরিচালক ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তাদের ঋণখেলাপির তথ্য অন্য খেলাপি গ্রাহকদের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোসিআইবিতে থাকে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে খেলাপি হয়েও নতুন করে ঋণ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না ব্যাংক পরিচালকদের। ব্যাংক পরিচালকদের অনৈতিক ঋণের লাগাম টেনে ধরতে এবং খেলাপি আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আইনের সংস্কার তদারকি জোরদার করতে হবে। ব্যাংক পরিচালকরাই যদি ঋণখেলাপি হন, তাহলে সাধারণ উদ্যোক্তারা কীভাবে অর্থ পাবেন বা আমানতকারীরাই কীভাবে লাভবান হবেন? আশ্চর্যের বিষয় হলো, খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে এমন অনৈতিকতার চর্চা চললেও তা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করা উচিত। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাতে নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমানত পেতেও ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ছে। কারণ অনেক ব্যাংকের ওপর আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। বিদ্যমান তারল্য সংকটের এটাও অন্যতম কারণ। আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন না আর। পরিস্থিতিতে কোনো দেশের সার্বিক অর্থনীতির উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার বিরূপ প্রভাব সব সেক্টরে পড়তে বাধ্য। অর্থনীতির সম্ভাব্য নিম্নগামিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন