নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিরুলিয়া গ্রাম

মোটরবাইকে ছুটলাম সাভারের রাজফুলবাড়িয়া হয়ে ধল্লা ব্রিজ পেরিয়ে মানিকগঞ্জ উপজেলার সিঙ্গাইর। ধারে কাছে ঘোরাঘুরির জন্য আমার অ্যাভেঞ্জারই হলো প্রিয় বাহন। বাইক চলছে, চলতে চলতে পৌঁছে যাই সিঙ্গাইর উপজেলায়। চারদিকে শুধু সবুজ সবজির ক্ষেত। নানা পদের সবজি। যেন সবজিরই রাজ্য। সবজি বাগানের মাঝ দিয়ে যাওয়া মেঠো পথে মোটরবাইক এগিয়ে যায় ভাটিরচর গ্রামে।

গন্তব্যে পৌঁছে প্রথমেই দেখি মৌমাছির চাষ প্রকল্প। ভ্রমণ মানেই অভিজ্ঞতা। তাই কিছুটা সময় কৃত্রিম উপায়ে মধু চাষের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ছুটি সবজি ক্ষেতে। একটা সময় হারিয়ে যাই সবজির ভিড়ে। বাতাসের দোলে ধনেপাতা, বেগুন আর সরিষা গাছ নড়েচড়ে। বেশি বাতাসে ভুট্টা গাছে ঢেউ খেলে। যেন এক অন্য জগৎ। যে জগতে শুধু প্রকৃতিই সব।

ঘুরতে ঘুরতে দেখি তেজোদীপ্ত সূর্যটা সেদিনের মতো তার আপন পথ খোঁজে। প্রকৃতির সেই ছন্দের তালে তালে হেঁটে বেড়াই। পালং আর লাল শাকের ক্ষেত জমিনে এনেছে ভিন্নমাত্রা। মাথার ওপর কুয়াশার ভেলা। দেখতে দেখতে ভরসন্ধ্যা। বাইক স্টার্ট। সবজির রাজ্য পেছনে ফেলে বাইক ছুটে যায় নিরাপদ রাত্রি নিবাসে। পরদিন যাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দৃষ্টিনন্দন পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বটতলায় দুপুরের আহারে ভাত-ভর্তা দিয়ে উদর পূর্তি করি। ছুটি সিঅ্যান্ডবি সড়ক ধরে শ্যামপুর গোলাপ গ্রামে। হাজার হাজার গোলাপের মাঝে নিজেকে কিছুটা সময় বিলিয়ে দিয়ে সবুজে বারো ভাজা খেতে খেতে চলে যাই বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি।

যাওয়ার সময় পথের সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে হতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের বাড়িতে। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় নিরাশ হতে হবে। আশপাশের মানুষও ভেতরে যেতে বারণ করবে। সবকিছু উপেক্ষা করে চলে যাই বাড়ির ভেতরে। উঠোনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখি মাথায় কিছু একটা ভর করছে। কি ভয় পেলেন? আরে নাহ, এটা অন্দরমহল দেখার নেশা। নেশার পারদ যখন চরমে, তখন ভেতরে ঢোকা আর ঠেকায় কে। স্থানীয় কিশোর মঞ্জুকে সঙ্গী করে প্রথমে অন্দরমহলে ঢুকি। এরপর একেবারে চিলেকোঠা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখি। জমিদার বাড়িটিতে মোট ১১টি স্থাপনা রয়েছে। লোকমুখে জানতে পারি বর্তমানে দুটো হিন্দু পরিবারের বসবাস রয়েছে। তারা নাকি জমিদারের বংশধর। কিন্তু আমার তা মনে হয়নি। আমরা যে স্থাপনাটিতে ঢুকেছি তার পুরোই ফাঁকা। ঘরের মেঝে, সিলিং, দরজা, জানালায় এখনো তত্কালীন আভিজাত্য দৃশ্যমান। নেই শুধু পাইক-পেয়াদাদের হাঁকডাক। কিংবা বাঈজির নূপুরের আওয়াজ। দেখতে দেখতে দোতলা পেরিয়ে ছাদ। এরপর চিলেকোঠায়।


বাহ্ আজ আর নেই কোনো জমিদারের নিরাপত্তা রক্ষীদের হুঙ্কার। নেই কোনো বাধা। ইচ্ছেমতো ছাদ থেকে পুরো বাড়ি তার আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখি। বাড়িটি একসময়কার প্রমত্তা তুরাগ নদের তীরে। বর্ষায় যার রূপ-যৌবন অনেকটাই ফিরে আসে। আসে না শুধু জমিদার রজনীকান্তের শৌর্যবীর্য। বাড়ির পূর্ব মালিক ছিল জমিদার নলিনী মোহন সাহা। তার কাছ থেকে হাজার ৯৬০ টাকা আনা দিয়ে জমিদার রজনীকান্ত ক্রয় করেছিলেন। বাড়িটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটা মন্দির, সদর ঘর, বিচার ঘর, সাজঘর, বিশ্রামাগার, পেয়াদা ঘর, ঘোড়াশালসহ বেশকিছু ঘর। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় রজনীকান্ত ঘোষের স্মৃতিসহ মূল্যবান অনেক কিছুই লুট হয়ে যায়। শুধু লুট হতে পারেনি জমিদার রজনীকান্তের নাম। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোয় ঘুরতে গেলে মনের ভেতর এক প্রকার নস্টালজিয়া কাজ করে।

পুরো বাড়িটি ঘুরে গিয়ে উঠলাম কোষা নৌকায়। চারপাশের অনেক গ্রাম বর্ষায় মূল ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কোষা নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক বটবৃক্ষের ছায়ায় নৌকা ভেড়াই। সেখান থেকে বিরুলিয়ার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা লিখে বুঝানো সম্ভব না। শুধু লিখব, ঢাকার আশপাশে থেকেও যারা এখনো সিঙ্গাইরের সবজি বাগান আর বিরুলিয়া দেখেননি, তারা যেন সুখময় জীবনানন্দ সূত্রটার খোঁজ এখনো পাননি।

 

 মুহাম্মদ জভেদ হাকিম

ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন