‘বেহুলা’র স্মৃতিতে ‘লখিন্দর’

বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৬৬ সালে জহির রায়হান পরিচালিত বেহুলা ছবির মাধ্যমে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ অভিনেতার। ছবিটি সে সময় সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। ছবিটিতে তিনি লখিন্দরের চরিত্রে অভিনয় করেন, তার বিপরীতে বেহুলা ছিলেন সুচন্দা। মূলত প্রথমবারের মতো জুটি বেঁধে ছবি করতে গিয়েই অভিনেতা রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচয় হয় সুচন্দার। পরবর্তী সময়ে জুটি অসংখ্য ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন। শুধু পর্দায় নয়, ব্যক্তিগতভাবেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল চমত্কার এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আজ রাজ্জাকের ৭৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে টকিজের মুখোমুখি হয়ে বেহুলা ছবির সূত্র ধরে সুচন্দা প্রকাশ করলেন রাজ্জাক তার অনেক অপ্রকাশিত গল্প। গ্রন্থনা করেছেন রুবেল পারভেজ

আমাদের প্রথম দেখা...
জহির রায়হান পরিচালিত বেহুলা (১৯৬৬) ছবিতে নায়ক হিসেবে প্রথমবারের মতো আবির্ভূত হন রাজ্জাক। সেই ছবিতে আমি ছিলাম তার নায়িকা; আমার চরিত্রের নাম বেহুলা রাজ্জাকের লখিন্দর। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, অথচ আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান বেহুলা ছবি নির্মাণের সেই দিনগুলো।

বেহুলার নায়িকা হিসেবে আমি আগেই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন পোশাক-আশাকের ট্রায়ালের কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখনই দেখি একজন লোক বারান্দায় বসে আছেন। সময় জহির রায়হানকে দেখে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সালাম দিলেন। জহির বললেন, ‘কী খবর কেমন আছেন’? এর পরই তার পিঠে চাপড় দিয়ে পুনরায় বললেন, ‘যান আপনাকে আমি হিরো বানিয়ে দিলাম। হিরো হিসেবে বেহুলায় আপনাকে নির্বাচিত করলাম।সে সময় আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ছবির নায়িকা হলেন উনি এবং আপনি নায়ক। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি লক্ষ করলাম, লোকটির চোখ বেশ ছলছল করছে এবং জহির রায়হানের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললেন, ‘আমাকে আপনি একদম হিরোর চরিত্রেই নিলেন?’ জহির বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।আমার তখন মনে হয়েছিল, ‘উনি হয়তো ভাবতে পারেননি জহির তাকে এত দ্রুত নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেবেন। সে মুহূর্তটার কথা মনে পড়ে খুব। মূলত তখন আমি জানতে পারি এনার নাম রাজ্জাক।

শুটিংয়ের প্রথম দিনের কথা বলব...
বেহুলার অন্যতম চরিত্র চাঁদ সওদাগর কখনো মনসা পূজা করতেন না। তার ছেলে লখিন্দর। বিপরীতে সাহী সওদাগর মনসা পূজা করতেন। আমি তার মেয়ে বেহুলা। লখিন্দর ময়ূর খুব পছন্দ করতেন। ময়ূর নিয়ে লখিন্দর সাহী সওদাগরের রাজ্যে আসে এবং ঘুরতে ঘুরতে তার ময়ূর একটি সাপ মেরে ফেলে। এরপর মনসা ক্ষিপ্ত হয়ে আদেশ দেয় ময়ূরের মালিককে শাস্তি দিতে। এরপর লখিন্দরকে ধরে নিয়ে আসা হয় সাহী সওদাগরের সামনে। তত্ক্ষণাৎ বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে বের হতেই ঘটনাটি আমি লক্ষ করি। একপর্যায়ে এখানেই আমাদের দুজনার দৃষ্টি বিনিময় হয়, আমাদের কোনো সংলাপ ছিল না। আমি তাকে দেখছি, সে আমাকে দেখছে। এই দৃষ্টি বিনিময়ের দৃশ্যটিই প্রথম দিনের শুটিং ছিল। শুটিং হয়েছিল পুরান ঢাকার স্টার সিনেমা হলের পেছনের দিকের একটি জমিদার বাড়িতে। প্রথম দিনের শুটিংয়ের পর আমরা দুজন কথা বললাম। তারপর আমরা আউটডোরের শুটিংয়ে রওনা হই। কাঠের বড় বড় বজরা ভাড়া করে নদীপথে যাত্রা করলাম।

তখনো সংকোচ কাটেনি আমাদের
শুটিং শুরুর পর একদিন আমাকে জহির রায়হান বললেন, ‘ছেলেটি (রাজ্জাক) একটু সংকোচ বোধ করছে। আপনি একটা কাজ করেন, ওর সঙ্গে আপনি যদি আরেকটু সাবলীল হতে পারেন, তাহলে আমার জন্য ভালো হয়।বললাম ঠিক আছে। এরপর শুটিং শেষ হলে আমরা চা-নাশতা খাওয়ার সময় গল্প করতাম, মিশতাম। একপর্যায়ে রাজ্জাকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আরেকটু সহজ হয়। উনিও সাবলীল হয়ে গেলেন। ফলে শুটিংয়ে আমাদের অভিনয় করতে কোনো সমস্যা হয়নি, বিনা সংকোচে যেকোনো শটই সফলভাবে শেষ করতে সক্ষম হই।

আরেকটা মজার ঘটনা...
বেহুলার শুটিং নিয়ে আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করছি। কারণে যে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে মুক্তি দিতে হবে। তখন আমরা রাত-দিন শুটিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত বোধ করেছিলাম। সময় গল্পের প্রয়োজনে শুটিং স্পটে লোহার বাসর ঘর বানানো হয়। আমরা যখন সেটে ঢুকব, তখন চাঁদ সওদাগরের কিছু শট নিচ্ছিলেন জহির। সময় তিনি আমাদের দুজনকে বলেছিলেন, ঘরের মধ্যে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। খানিক বাদে আমাদের শট নেবেন। সেটে ঢুকে দেখি রানী সরকার সুন্দর করে সাজানো বাসর ঘরের খাটের ওপর বসে আছেন। এরপর আমরাও সেখানে বসি। একপর্যায়ে দুজন দুটো বালিশে শুয়ে পড়ি এবং কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে যাই তা টের পাইনি। পরে সবাই বলেছিল আমরা নাকি অঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম। যাহোক, জহির তার অন্য কাজ শেষ করে আমাদের শট নেয়ার জন্য সেটে ঢুকেই দৃশ্য দেখে এবং বাকিদের ইশারায় বললেন, কেউ যেন কোনো কথা না বলে, শব্দ না করে। তিনি নির্দেশ দিলেন পুরো বাসরঘরটি লাইটিং করতে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম, আমার গলার কাছে ঠাণ্ডা কী যেন একটা নড়াচড়া করছে। অকস্মাৎ তাকিয়ে দেখি, একটি কালকেউটে সাপ। চিত্কার করে উঠলাম সাপ, সাপ বলে। জহির আসলে আমার অজান্তেই আমার ওপর সাপ ছেড়ে দিয়ে শট নিচ্ছিল। এরপর তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম আপনি কথা বলবেন না। ঘুমিয়ে থাকেন আমি শট নিচ্ছি।খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিচালকের নির্দেশে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সময় রাজ্জাক আমার হাত পাশাপাশি ছিল এবং আমি তার হাত ধরে ফেললাম চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই। ভয়ে আমি তখন জড়োসড়ো, দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বললাম রাজ্জাক সাহেব সাপ। তখন রাজ্জাক বললেন, ‘চুপ, কোনো কথা বলবেন না।আসলে পরিচালকের ইঙ্গিত তিনি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সাপ আমার গলা থেকে নেমে গা বেয়ে রাজ্জাকের পায়ের কাছে যখন গেল, তখন জহির বললেন, ‘রাজ্জাক সাহেব পাটা আবার খাটের ওপর ধপাস করে ফেলেন।তিনি তাই করলেন এবং যথারীতি সাপ ফণা তুলল।

রাজ্জাক আমার জয়জয়কার
মুক্তির পর বেহুলা এতটাই সুপারডুপার হিট হয় যে, পরবর্তী তিন-চার মাস টানা প্রেক্ষাগৃহে চলেছে, পুরোটা সময় হাউজফুল দর্শক ছিল। তখন আমাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠল। একপর্যায়ে আমার নাম সুচন্দা থেকে বেহুলা হয়ে গেল। লোকে আমাকে দেখলেই বলত, ‘ওই যে বেহুলা যাচ্ছে।

ছবিটির সফলতার পর থেকে রাজ্জাক আমার জুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ইন্ডাস্ট্রিতে। বিশেষ করে প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর, হল মালিকদের কাছে আমরা তখন সাংঘাতিক জনপ্রিয় জুটি। প্রযোজকদের বেশির ভাগই ছিলেন অবাঙালি। তারা বলতেন, ‘আগার পিকচার মে সুচন্দা-রাজ্জাক হ্যায় তো কিতনা লাগেগা লে জায়িয়ে।

রাজ্জাক আমি ৪০টির মতো ছবিতে জুটি বেঁধেছি। আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। আমার সঙ্গে তার সুন্দর সম্পর্ক একপর্যায়ে আমাদের উভয়ের পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও হূদ্যতা তৈরি করেছিল। তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে শ্রদ্ধা সম্মান দিয়ে গেছেন। সত্যিই নায়করাজ রাজ্জাকের মতো একজন বন্ধু, সহকর্মী পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন