অর্থনৈতিক পর্যালোচনা

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কোন পথে?

ড. জাহিদ হোসেন

অর্থবছর ২০২০-এর প্রায় সাত মাস শেষ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরাসরি তথ্য নেই। সরকার এখনো দশমিক শতাংশের আশপাশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করছে। হলে ভালো, তবে আশাটা কতখানি যৌক্তিক, তা বুঝতে হলে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত সূচকগুলোর ওপর নজর দেয়া জরুরি। মাসিক ভিত্তিতে পাওয়া যায় এমন সূচকগুলোর মধ্যে আছে রফতানি, আমদানি, শেয়ারবাজারের অবস্থা, উন্নয়ন খরচ, ঋণপ্রবাহ, বিদেশ থেকে বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ মূল্যস্ফীতি। 

রফতানির ক্ষেত্রে খবর ভালো নয়। প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি দশমিক শতাংশ কমেছে। পোশাক রফতানি কমেছে দশমিক আর পোশাকবহির্ভূত রফতানি কমেছে শতাংশ। ভারত ছাড়া সব বাজারে আমাদের রফতানি কমেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য ইউরোপ, যেখানে রফতানি দশমিক শতাংশ কমেছে। আমেরিকায় কমেছে দশমিক শতাংশ। আমাদের রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ দুই বাজারে হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুর্বলতা, রফতানিতে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অবক্ষয় এবং রফতানি বহির্মুখীকরণে পিছিয়ে থাকা ধসের মূল কারণ।

প্রথম পাঁচ মাসে মোট আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক শতাংশ কমেছে। বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে দশমিক শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধি নভেম্বরে দশমিক শতাংশে নেমে আসে, যা কিনা গত নভেম্বরে ছিল ১৪ শতাংশ। এতে প্রতীয়মান হয় যে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের দুর্বলতা কাটেনি, উল্টো হয়তো বেড়েছে। উৎপাদনে ব্যবহার করার উপাদান আমদানি কমেছে দশমিক শতাংশ। উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহারে ঘাটতির আলামত এটা।

শেয়ারবাজারের পতনের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আস্থার সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অর্থনীতির চাকা বেগবান থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। অন্য কারণও আছে, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়।

বাণিজ্য মেলায় বিক্রির প্রবৃদ্ধি কতটা, তা মেলা শেষ হলে জানা যাবে। তবে আগের বছরের তুলনায় তেমন বেশি প্রাণ লক্ষণীয় নয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক পণ্য বিক্রিতে ভাটার প্রবণতা দেখা গেছে অন্য ক্ষেত্রেও। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খুব একটা বাড়েনি। নামিক মজুরির প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে সামান্য বেশি। আর কর্মসংস্থানের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। শুধু পোশাক শিল্পেই ৩২ হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে বলে শোনা যায়। 

সরকারি বিনিয়োগের খবর কেমন? বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থছাড় প্রথম ছয় মাসে মাত্র দশমিক শতাংশ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়। মোট উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দের ২৪ দশমিক শতাংশ অর্থছাড় হয়েছে, যা আগের বছরের প্রথমার্ধে ছিল ২৭ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগে যে জোয়ার ইদানীং দেখা গেছে, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হয়।


প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব ছাড়াও বছর আর্থিক টানাপড়েনও এর কারণ হতে পারে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক শতাংশ। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ সারা বছরের লক্ষ্য প্রথম সাত মাসেই ছাড়িয়ে গেছে। বেতন-ভাতা, ভর্তুকি, সুদ সবই দ্রুত বেড়েছে। ফলে উন্নয়ন খরচ অর্থায়নে কিছু সমস্যা হওয়াটা স্বাভাবিক।

সুখবর শুধু রেমিট্যান্সে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ দশমিক শতাংশ বেড়েছে। মোটা দাগে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ওমান কুয়েত থেকে। ওইসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং নগদ ভর্তুকি টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন এতে ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। এছাড়া দেশে অর্থনৈতিক মন্দাও হয়তো প্রবাসীদের বেশি অর্থ পাঠাতে তাগিদের কাজ করেছে, যাতে তাদের প্রিয়জনরা মন্দার মোকাবেলা সহজে করতে পারেন।

সারা বছর (২০১৯) ধরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও শেষের দিকে পেঁয়াজের ঝাঁজ গ্যাসের মূল্যতাপের কারণে মূল্যস্ফীতি আবার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসে। জোগান খরচ বৃদ্ধির ধাক্কা এবং চাহিদার টান দুটোই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি এবং তার মুদ্রানীতিতে সংকুলান মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে।

মন্দা মোকাবেলায় করণীয় কী? প্রথম পদক্ষেপ সমস্যাটাকে স্বীকৃতি দেয়া। অর্থনীতি কখনো বছরের পর বছর উচ্চ থেকে উচ্চতর গতিতে বাড়তে থাকে না। বিশেষ করে যখন সংস্কার কার্যক্রমে পরিপূর্ণতার অভাব, ব্যাংকিং খাতে ঝামেলা, মুদ্রা বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত, বন্দরে জটিলতা, ব্যবসায় মাত্রাহীন আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ এবং দক্ষ জনশক্তি পর্যাপ্ত অবকাঠামো অনুপস্থিত। বিশ্ববাণিজ্য অনিশ্চয়তা তো  আছেই, যদিও চীন, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধে বিরতি শুরু হয়েছে। আর ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে কতটা ঠুনকো, তা ইদানীংকালের ঘটনা আবার মনে করিয়ে দিয়েছে।

নীতি সহায়তা সম্প্রসারণের দাবি আসছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহল থেকে। কর সুবিধা, নগদ ভর্তুকি, টাকা বিনিময় হারের খাতভিত্তিক প্রয়োগ, ঋণ মওকুফ বা পুনর্গঠন কিংবা পুনঃতফসিলীকরণ, কম সুদে ঋণ, জ্বালানি বিদ্যুত্মূল্যে ভর্তুকি, আমদানি শুল্কের মাধ্যমে সুরক্ষা ইত্যাদি। নীতি সহায়তা যেন সব রোগের চিকিৎসা। অনেকটা প্যারাসিটামল বা মলমের মতো।

সবাই চান ব্যবসায়িক দুর্দিনের বোঝাটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। অন্য মানে সরকার, যেটা শেষমেশ পার হয়ে যায় বর্তমান ভবিষ্যৎ করদাতার ওপর।

নীতি সহায়তার যুক্তি আর ফলাফল দুটোই পুনরায় ভাবা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা টেকসই প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত। মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে, খাতভিত্তিক নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সীমিত। অভ্যন্তরীণ বা বিদেশ থেকে ঋণপ্রাপ্তি সীমাহীন বা মূল্যহীন নয়। অর্থনৈতিক সুশাসনের দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে কেবল কর সুবিধা বা ভর্তুকি দিয়ে প্রবৃদ্ধির বিশালতা গুণগত মান ধরে রাখা অনেক কঠিন।

নিয়ন্ত্রণ কাঠামো সহজীকরণ, অবকাঠামো নির্মাণে ভেজাল দীর্ঘসূত্রতা কমানো, তরুণ শ্রমশক্তিকে মানবসম্পদে পরিণত করা, করনীতি এবং প্রশাসন করদাতা ব্যবসাবান্ধব করা, প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা এবং নীতি কাঠামোকে আমলাতান্ত্রিক বাতিকমুক্ত করতে পারলে প্রবৃদ্ধি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন মহাসড়ক ধরে এগোবে। অন্যথায় প্রবৃদ্ধির সুফল কেবল মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত থেকে উন্নয়নের পরিহাসে পরিণত হবে।

 

. জাহিদ হোসেন: অর্থনীতিবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন