ব্যাংকিংয়ে নীতি-নৈতিকতা : সুদহারের গ্রহণযোগ্যতা

ড. এসএম আবু জাকের

ভদ্রমহিলার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিন কন্যা রেখে মারা যান। সেই থেকে ভদ্রমহিলা স্কুলপড়ুয়া তিন কন্যার ভরণ-পোষণ জোগাড় করতে জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদের ওপর। স্বামীর গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফান্ডের ২০ লাখ টাকা ব্যাংকে মাসিক আয় প্রকল্পে আমানত হিসেবে রেখেছেন। ১২ শতাংশ সুদে যে মাসিক আয় হয়, তা দিয়ে তার সংসারটা মোটামুটি চলে যায়। বছর শেষে ব্যাংকে এসে যখন তিনি জানতে পারলেন সুদহার শতাংশ হয়ে গেছে, তখন দুই চোখে তার অশ্রুধারা যেন থামতে চায় না। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাকে শঙ্কিত করে তুলছে। শতাংশ সুদে যে আয় হবে তা দিয়ে বাসাভাড়া দিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বিকল্প কোনো আয়ের ব্যবস্থাও নেই। মেয়েদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করতেই তার সংবিৎ হারানোর উপক্রম।

অন্য এক প্রেক্ষাপট। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার আগে তার সঞ্চিত কোটি টাকার স্থায়ী আমানতে একমাত্র ছেলেকে নমিনি করে যান। ছেলে এমএ পাস করে একটি কোম্পানিতে চাকরি করত। বাবার মৃত্যুর পর ছেলে কোটি টাকা হাতে পেয়ে দেখল সে ব্যাংক থেকে যে সুদ পায়, তা দিয়ে তার সংসারটা ভালোভাবেই চলে যায়। তাই কষ্টের চাকরিটা ছেড়ে দিতে দেরি করল না। সে কর্মহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে লাখ লাখ পরিবারের আয়ের মূল উৎস হলো ব্যাংকের সুদ। পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের প্রায় সব গ্রাহকই সুদ-আয় দিয়ে সংসার চালান। দেশে কর্মহীন মানুষের জন্য কোনো বেকার ভাতা নেই। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেলে কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে গোটা সংসার অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যায়। তখন সঞ্চিত অর্থ থেকে সুদ আয়ই একমাত্র ভরসা হয়ে পড়ে। সঞ্চয় যে দুর্দিনের বন্ধু, তা ভুক্তভোগী পরিবার বেশ ভালো করে বুঝতে পারে। সঞ্চয় না থাকলে কিংবা সঞ্চিত অর্থ থেকে ভালো সুদ আয় পাওয়া না গেলে ওইসব পরিবার দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে, যা অর্থনীতিতে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তাই ধরনের পরিবারের স্বার্থে সুদহার যত বেশি হয় ততই মঙ্গল।

আবার সুদহার বেশি হলে মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। বিনিয়োগ থমকে দাঁড়ায়। বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। পুঁজি হারানোর ঝুঁকি তো আছেই, তদুপরি মুনাফা সুদহারের চেয়ে কম হওয়ার ঝুঁকিই প্রবল থাকে। তাই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ কিংবা মুনাফার হারের তুলনায় আমানতের ওপর অর্জিত সুদহার যদি বেশি হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে অলস সঞ্চয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবেন। এভাবে বিনিয়োগ না হতে থাকলে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না; যা অর্থনীতির জন্য মোটেও মঙ্গল হতে পারে না।

উন্নত অর্থনীতিতে অনুন্নত অর্থনীতির তুলনায় সুদহার কম থাকে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেও সুদহার শতাংশের কম। অনেক দেশে আমানতের ওপর কোনো সুদ দেয়া হয় না। উল্টো আমানত রক্ষণাবেক্ষণের খরচ হিসেবে কিছু চার্জ কেটে রাখা হয়। আমরা অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছি। তাই সুদহারও কমার কথা। কিন্তু বিপরীত চিত্রই দৃশ্যমান। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় চলতে না দিলে এমনই হয়।

দেশে ব্যবসায়ী মহল তথা ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের সুদহারের ওপর মোটেও সন্তষ্ট নন। তারা এক অংকের সুদহারে সুদহার চান। উন্নয়নশীল উন্নত দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এক অংকের সুদহারে ঋণ সুবিধা পাওয়া অত্যাবশ্যক। পুঁজির সংস্থানের জন্য তাদেরকে দেশের আমানতকারীদের সুদহারের সঙ্গে যেমন প্রতিযোগিতা করতে হয়, তেমনি পণ্যমূল্য নির্ধারণে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগীদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হয়। আমাদের দেশের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বেশি প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সুদহার একটি মূল্যবান অনুষঙ্গ। তাই ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বিশ্ববাজারে টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণের সুদহার এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যাতে তা প্রতিযোগী রাষ্ট্রগুলোর সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। হিসাবে আমাদের ঋণের সুদহারকে মোটেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে না। অর্থাৎ ঋণের সুদহার শতাংশে নির্ধারণ করা হলেও তা যেন অতি সুদ হিসেবে গণ্য হবে। তাই বিশ্ববাজারে ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীদের টিকিয়ে রাখতে হলে সুদহার হ্রাস করার কোনো বিকল্প নেই।

ঋণের সুদহার কমে গেলে আমানতের সুদহারও কমে যাবে। এতে ক্ষুদ্র আমানতকারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একটি পক্ষকে টিকিয়ে রাখতে হলে অন্য পক্ষের স্বার্থে কিছুটা আঘাত আসবেই। এখন সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে কোন পক্ষের স্বার্থ বেশি জরুরি। সিদ্ধান্ত অবশ্যই গবেষণার ব্যাপার, মোটেও রাজনৈতিক কিংবা আবেগের ব্যাপার নয়। আবেগ দিয়ে অর্থনীতি চলে না। আবেগের বশবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অর্থনীতিকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিসংগত। উৎপাদকশ্রেণীর স্বার্থকে সবার ওপর স্থান দেয়া বাঞ্ছনীয়। টাকা থাকলেই যে পণ্য পাওয়া যাবে তার যে নিশ্চয়তা থাকে না, তা আমরা সম্প্রতি পেঁয়াজের বাজারে প্রমাণ পেয়েছি। ভর্তুকি দিয়ে কিংবা সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে যদি পেঁয়াজচাষীদের উৎসাহিত করা যেত, তাহলে দেশে পেঁয়াজ চাষে চাষীরা আগ্রহী হয়ে উঠতেন এবং দেশে পেঁয়াজের সংকট হতো না। পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা হওয়ায় বেশ কথা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। পেঁয়াজের স্থলে যদি চাল হতো, তখন হতো পাথর ছোড়াছুড়ি; যা অবশ্যই থামানো মুশকিল হতো। অর্থাৎ অন্য দেশের পণ্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকা যায় না। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনে খামখেয়ালিপনার কোনোই সুযোগ নেই। আর স্বদেশী পণ্যের উৎপাদন জোগান নিশ্চিত করার জন্য ঋণের সুদহার অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে রাখা বাঞ্ছনীয়।

উৎপাদক শ্রেণীকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমানতকারীদের স্বার্থে কিছুটা আঘাত আসবে। আঘাতকে সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় কাদের কীভাবে আনা যায়, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। আমানতের সুদহার কমে গেলে যাদের অবস্থান আত্মপোষণ পর্যায়ের নিচে চলে যাবে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যেমন সুদের ওপর উৎসে আয়কর পরিহার, স্বল্প মূল্যে ওষুধ চিকিৎসা সেবা, নিত্যপণ্যের রেশন কার্ড প্রদান, ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ ইত্যাদি। এটা মনে রাখা জরুরি যে দারিদ্র্যের বিস্তার বাড়বে মনে করে যদি আমানতের সুদহার না কমানো হয়, তাহলে ওই কারণে যদি উৎপাদন খাত অচল হয়ে যায়, তখন বেকারত্ব বেড়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাই উৎপাদন খাতকে কোনো প্রকারেই অবহেলার সুযোগ নেই।

আল কোরআনে আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন। সব ধর্মগ্রন্থে সুদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অ্যারিস্টটল, প্লেটো থেকে শুরু করে কার্ল মার্ক্স, জন কিন্সসহ অসংখ্য দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী অর্থনীতিবিদ সুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সে মিছিলে শরিক হয়েছে আমাদের বর্তমান ব্যবসায়ী সমাজ। দেশের সব উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী-ঋণগ্রহীতা বর্তমান সুদহারকে অসহনীয় মনে করছেন। আমাদের সমাজেও যিনি সুদ খান, তাকে সুদখোর বলে সম্বোধন করা হয়; যা একপ্রকার গালি। প্লেটো সুদকে বলেছেন, The social evils created by usury অ্যারিস্টটল বলেছেন, The unnatural character of usury উৎপাদক শ্রেণী বা রফতানিকারকরা বাজারে টিকে না থাকলে তারা বাজার হারাবে। আর একবার যদি বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়, সেই বাজার ফিরে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পোশাক খাতের বাজার ধীরে ধীরে ভিয়েতনাম অন্যান্য দেশে চলে যাওয়া এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮ সালে ভিয়েতনামে আমানতের গড় সুদহার ছিল দশমিক শতাংশ এবং ঋণের গড় সুদহার ছিল দশমিক ৪০ শতাংশ (মালয়েশিয়া .৯৩ শতাংশ) আর আমাদের ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদহার শতাংশ পেলেই খুশি, যা আমরা করতে পারছি না। তাহলে বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্নই থেকে যাবে?

পুঁজিবাদী সমাজ সুদনির্ভর। যে যে উপকরণের মাধ্যমে পুঁজিবাদের শোষণযন্ত্র চালু থাকে, সুদ তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের সমাজ পুঁজিবাদী সমাজ। তাই সুদও সমাজের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে সেটিকে উত্খাত করা মোটেও সহজ কাজ নয়। সুদবিহীন সমাজ ব্যবস্থা কিন্তু অলীক কল্পনা নয়। আমাদের দেশে কোনো কোনো খাতে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত ঋণের সুদহার বিদ্যমান। আর অনেক দেশে সেটি শতাংশের কম অর্থাৎ শূন্যের কাছাকাছি। সুদবিহীন সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্র শ্রেণী লাভবান হয়, আর ধনিক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আপামর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের ব্যাপারে কেউ সোচ্চার হয় না। বর্তমানে দেশে একজন সঞ্চয়কারী যদি বার্ষিক থেকে শতাংশ সুদ বা মুনাফা পান, একজন শেয়ারহোল্ডারকে (ব্যাংকের) কেন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিতে হবে? একটি সুস্থ অর্থনীতিতে সঞ্চয়ের সুদহার আর বিনিয়োগের লাভের হার সাযুজ্যপূর্ণ থাকে। এই বিচারে আমাদের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে আছে তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিধান মোতাবেক কোনো কোম্পানি ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড না দিলে সে কোম্পানিকে ক্যাটাগরি কোম্পানি বলা হবে না। তাই ব্যাংকগুলো বাজারে সুনাম ধরে রাখার জন্য কার চেয়ে কে বেশি মুনাফা করে ক্যাটাগরি সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকবে, সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এর প্রভাব পড়ে ঋণ আমানতের সুদহারে। কারণ ঋণের সুদহার এমনভাবে নির্ধারণ হয়, যাতে অন্যূন ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয়া যায়। ব্যাংক কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা উৎপাদন খাতের জন্য মোটেও সহায়ক নয়, বরং আত্মঘাতী।

একটি পরিশীলিত অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুদ আয়ের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন কমাতে হবে, তেমনি ব্যাংকের ডিভিডেন্ড প্রতিযোগিতা বন্ধ করে স্বাভাবিক মুনাফার ওপর ভর করে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ করা সময়ের দাবি।

. এসএম আবু জাকের: ব্যাংকার
[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন