গ্যাসের মজুদে চলবে ১১ বছর

গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করুন

বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে, একটা সময় ধরনের প্রচারণা থেকে গ্যাস রফতানির পক্ষে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল একটি পক্ষ। আর এখন বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, রকম ধারণা অনেকের চিন্তা কর্মকে প্রভাবিত করছে। কারণে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। সুতরাং দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আজ অবধি দেশে গ্যাস অনুসন্ধান মূলত সহজভাবে চিহ্নিত কাঠামোগুলোর মধ্যেই সীমিত। দেশের পূর্বাঞ্চলে ধরনের কাঠামোগুলোয় যথেষ্ট গ্যাস পাওয়া গেলেও পরবর্তী পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে জটিল অপেক্ষাকৃত সুপ্ত সম্ভাবনাকে অনুসন্ধান কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের মতো বৃহৎ -দ্বীপ অঞ্চলে ভূগর্ভে রকম সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। দেশের এক বিরাট ভূখণ্ড এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে। মূল ভূখণ্ডের বাইরে বিরাট সমুদ্রবক্ষকে বাংলাদেশের মানচিত্রে যুক্ত করার কৃতিত্বে আমরা গর্বিত। কিন্তু সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানকাজের মাত্রা হতাশাজনক। অগভীর গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের মোট ব্লকের সংখ্যা ২৬। কেবল চারটি ব্লকে সীমিত অনুসন্ধান ছাড়া বাকি ২৪টি ব্লক খালি পড়ে রয়েছে। অথচ ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিষ্পত্তি হওয়ার পর মিয়ানমার রাখাইন সমুদ্রসীমানায় যে জোরালো অনুসন্ধানকাজ শুরু করে, তার সুফল দেখা যায় সেখানে বহুসংখ্যক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সার্ভিস কোম্পানির সাহায্যে একটি সিসমিক জরিপ ডাটা প্যাকেজ তৈরি করা আবশ্যক, যেটি মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে নামে পরিচিত। পেট্রোবাংলা ২০১৪ সালে এটি করার উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে চার বছরেও তা সম্পাদন করা যায়নি। অথচ সাগরের গ্যাস দেশের জ্বালানি সংকট লাঘবে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমার ভারত তাদের সমুদ্রসীমানায় গ্যাস সম্পদ আবিষ্কার আহরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমানায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে না পারার অন্যতম কারণ মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে-নির্ভর ডাটা প্যাকেজের অভাব। বিষয়ে সরকারের উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।

গ্যাস অনুসন্ধান উৎপাদনের সনাতনী পন্থাগুলোর বাইরে অসনাতনী গ্যাস সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি মোক্ষম এলাকা বলে ভূতাত্ত্বিকভাবে জানা যায়। কারিগরি ভাষায় এগুলোর মধ্যে থিন বেড প্রসপেক্ট, সিনক্লাইনাল প্রসপেক্ট, হাই প্রেশার প্রসপেক্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, যাদের কোনো কোনোটি পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গ্যাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অসম্পূর্ণ অপরিপক্ব পর্যায়ে থাকা অবস্থায় গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হওয়ার স্লোগান দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। অথচ এটিই দেশের নীতিনির্ধারণী মহলকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয়, ফলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের চেয়ে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির ওপর অধিকতর আগ্রহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় আনা হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশ গ্যাসের যে সংকটে পড়েছে, তার তাত্ক্ষণিক সমাধানে সাময়িকভাবে সীমিত পরিমাণ এলএনজি আমদানির যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপকভাবে ব্যয়বহুল এলএনজি-নির্ভর হলে দেশের অর্থনীতির ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া অবশ্যম্ভাবী।

ব্যয়বহুল আমদানীকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভালো অবস্থান ধরে রাখা কঠিন। তাছাড়া তেলপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চলগুলোয় প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকে। এর প্রভাব আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে পড়লে দাম বেড়ে যাবে, যার বোঝা বহন করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের উচিত প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বিশেষত অফশোরে আরো জোরদার করা। এতে বিনিয়োগের জন্য স্বল্পমূল্যে জ্বালানি সরবরাহ করা সহজ হয়ে উঠবে, যা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণেও সহায়ক হতে পারে। মিয়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি আসার অন্যতম কারণ কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ হয়েও গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করতে পারিনি। সরকার গ্যাস উত্তোলনের চেয়ে গেল কয়েক বছরে আমদানির ওপর বেশি জোর দিয়েছে। নীতি নিয়ে সমালোচনা জারি রয়েছে। আমরা চাইব আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান আরো জোরদার করা হবে। এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা, বাপেক্সকে আরো শক্তিশালী করা জরুরি। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বা বিদেশী সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভেঞ্চারেও যাওয়া যায়, তার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র আইন তৈরি করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন