যেভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন অ্যাঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট কন্যা ইসাবেল

বণিক বার্তা অনলাইন

দেশ বেচে দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলার শীর্ষ ধনী নারী ইসাবেল দোস সান্তোস! সম্প্রতি ফাঁস হওয়া বিপুল পরিমাণ নথিপত্রের ভিত্তিতে এমন মন্তব্যই করেছে একাধিক গণমাধ্যম। অনুসন্ধানী সংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের (আইসিআইজে) হাতে পৌঁছানো এসব নথি যাচাই করে বিবিসি, আল জাজিরা, গার্ডিয়ানসহ প্রথম সারির বেশ কয়েকটি পত্রিকা এ নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে। এসব প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শোষণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অ্যাঙ্গোলার সাবেক প্রেসিডেন্টের কন্যা ইসাবেলের সম্পদ গড়ার পেছনের গল্প।

জ্বালানি তেল ও হীরার মতো প্রকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অ্যাঙ্গোলা। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। বাবা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেই ইসাবেল বনে গেছেন বিলিয়নেয়ার। রাজনীতিক বাবা হোসে এদুয়ার্দো দোস সান্তোস ১৯৭৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন অ্যাঙ্গোলার ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি। তবে নিজের মনোনীত ব্যক্তি উত্তরসূরী হলেও তিনিই এখন তার পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। এর মধ্যে ফাঁস হয়েছে বিপুল পরিমাণ নথি।

নথিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে ইসাবেল এবং তার স্বামীকে একাধিক সন্দেহজনক চুক্তিতে মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তবে ইসাবেলের দাবি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। অ্যাঙ্গোলার সরকার তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

ইসাবেল এখন যুক্তরাজ্যে বসত গড়েছেন। লন্ডনে তার বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। অ্যাঙ্গোলা সরকার তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় তদন্ত করছে। দেশে তার সমস্ত সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে।

ইসাবেলের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য নিয়ে ফাঁস হওয়া সাত লাখেরও বেশি নথি দেখার সুযোগ পেয়েছে বিবিসির প্যানোরামা প্রোগ্রাম। এসব নথির বেশিরভাগ ফাঁস করেছে আফ্রিকার প্ল্যাটফর্ম টু প্রটেক্ট হুইসেল-ব্লোয়ার্স। আইসিআইজের মাধ্যমে এসব তথ্য পর্তুগালের এক্সপ্রেসো পত্রিকাসহ ৩৭টি গণমাধ্যম যাচাই করেছে। দেশটির রাজধানীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে আইসিআইজে এ ঘটনার নাম দিয়েছে ‘লুয়ান্ডা লিকস’। 

অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সংস্থা সোনাঙ্গলের ব্রিটিশ সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে একটি সন্দেহজনক চুক্তি লন্ডন থেকে সম্পন্ন করেন ইসাবেল। সেটি ছিল তার সবচেয়ে বড় অংকের দুর্নীতি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বাবার বদৌলতে এই সংস্থার দায়িত্ব পান ইসাবেল। কিন্তু ২০১৭ সালে বাবা প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলে তার এই পদটি হুমকির মুখে পড়ে। মাত্র দুই মাস পরেই তাকে বরখাস্ত করা হয়। একই দিনে তার নামে ৫০টিরও বেশি ভাউচার পাঠায় দুবাইয়ের পরামর্শক সংস্থা ‘ম্যাটার বিজনেস সলিউশনস’। সোনাঙ্গল ত্যাগের আগে ম্যাটারের ৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের একটি সন্দেহজনক বিলে তিনি সই করেন। যদিও ইসাবেলের দাবি, ম্যাটারের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে, তারই বিজনেস ম্যানেজার এটি পরিচালনা করেন এবং এর মালিক তার বন্ধু। ম্যাটার থেকে আসা কয়েকটি বিল ভাউচারের মধ্যে খাত উল্লেখ ছাড়া ব্যয় বাবদ ৪ লাখ ৭২ হাজার ইউরো, বিষয় উল্লেখ ছাড়াই আইনি সেবা বাবদ ৯ লাখ ২৯ হাজার মার্কিন ডলার পাওনা দাবি করা হয় । এছাড়া ৬ লাখ ৭৬ হাজার ইউরোর দুটি বিল একই কাজের জন্য একই তারিখে পাঠানো হয়। এ দুটি বিল ভাউচারেই সই করেন ইসাবেল। অথচ ততোদিনে তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ম্যাটার বিজনেস সলিউশনসের আইনজীবী দাবি করছেন, তেল শিল্পের পুনর্গঠনের জন্য সোনাঙ্গল আগে যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল সে কাজটিই তার মক্কেল এগিয়ে নিচ্ছিল। সুতরাং বিল ভাউচার সঠিক ছিল। ইসাবেলের আইজীবীর দাবি, তার মক্কেল কোনো বেআইনি কাজ করেননি। কারণ দুই প্রতিষ্ঠানের চুক্তিটি সোনাঙ্গলের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সম্মতির ভিত্তিতেই হয়েছিল। আর বরখাস্ত হওয়ার কারণে বিল পরিশোধের কোনো এখতিয়ার ইসাবেলের ছিল না।

ইসাবেলের ব্যক্তিগত সম্পদের বেশিরভাগই পর্তুগিজ জ্বালানি কোম্পানি গালপের শেয়ার কেনার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। ২০০৬ সালে সোনাঙ্গলের মাধ্যমেই এ অংশ কেনে তার একটি কোম্পানি। নথিতে দেখা যাচ্ছে, শেয়ার মূল্যের মাত্র ১৫ শতাংশ তিনি পরিশোধ করেন, আর বাকি ৭ কোটি ডলারের ঋণ সোনাঙ্গল থেকেই অস্বাভাবিক কম সুদে পরিশোধের সুযোগ নেন। শর্তানুসারে ১১ বছরের গ্রেস পিরিয়ডে এ ঋণ নেয়া হয়।  গালপে তার অংশীদারিত্ব এখন ৭৫ কোটি ইউরোরও বেশি।

২০১৭ সালে অবশ্য সান্তোসের কোম্পানি সোনাঙ্গলের এ ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুদের ৯০ লাখ ইউরো এতে যুক্ত না করার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

ওই সময় সোনাঙ্গলের দায়িত্বে ছিলেন ইসাবেল এবং তিনি এ টাকা নিজের ঋণ পরিশোধ বাবদই নিয়েছিলেন। চুক্তির ছয় দিন পর তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং সোনাঙ্গলের নতুন ম্যানেজমেন্ট ওই টাকা ফেরত এনেছে। সান্তোস দাবি করেন, গালপের অংশ কেনার উদ্যোগ তিনিই নেন এবং সোনাঙ্গল এ চুক্তি থেকে টাকাও পেয়েছে।

তেলের মতো হীরার ব্যবসা সংক্রান্ত চুক্তিতেও ঘাপলা করেন ইসাবেল। এবার মূখ্য ভূমিকা রাখেন তার স্বামী সিন্দিকা দোকোলো। অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রীয় হীরক সংস্থা সোডিয়ামের সঙ্গে ২০১২ সালে একতরফা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। আধাআধি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সুইস বিলাসবহুল জুয়েলারি ডি গ্রিসোগোনোর শেয়ার কেনার চুক্তি হয়। 

তবে এর অর্থায়ন করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। নথিতে দেখা যায়, এই চুক্তির ১৮ মাস পর সোডিয়াম ওই শেয়ারে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। সেখানে দোকোলো বিনিয়োগ করেন মাত্র ৪০ লাখ ডলার। সফলভাবে চুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্ততার পুরস্কার স্বরূপ সোডিয়াম তাকে দেয় ৫০ লাখ ডলার। সুতরাং আধাআধি শেয়ার নিতে তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয়নি। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকে অ্যাঙ্গোলার কিছু হীরা কেনার অধিকারও দিয়েছিলেন।

নথিতে আরো দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় হীরক প্রতিষ্ঠান এ টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে। ওই ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিলেন সান্তোস।  ৯ শতাংশ সুদে এ ঋণ নেয়া হয়েছিল। আর এতে ব্যাংক যাতে কোনোভাবেই লোকসানের মুখে না পড়ে সে জন্য প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশে এর গ্যারান্টি ছিল।

সোডিয়ামের বর্তমান প্রধান ব্রাভো দা রোসা বলেন, অ্যাঙ্গোলাবাসীদের জন্য এ চুক্তি একটা গলার কাঁটা। কারণ ৯ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে ঋণ শোধ করতে গেলে ২০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় হবে। অথচ এ চুক্তির মাধ্যমে অ্যাঙ্গোলাবাসী এক কানাকাড়িও পায়নি। অ্যাঙ্গোলার সরকার বলেছে, হীরা অতি স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়েছে। এতে সরকারের একশ কোটি ডলার লোকসান হয়েছে। নিজের অংশীদারিত্ব না থাকায় ডি গ্রিসোগোনোর ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি ইসাবেল। যদিও নথি অনুসারে তিনি মিথ্যা বলেছেন। দোকোলোর আইনজীবীর দাবি, তিনি ডি গ্রিসোগোনোতে ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছেন।

এখানেই শেষ নয়, ইসাবেল নামমাত্র মূল্যে  হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ জমিজমা। প্রকল্পের নামে রাজধানীর ৯ কোটি ৬০ লাখ মূল্যমানের জমি তিনি কিনে নেন মাত্র ৫ শতাংশ মূল্যে। ইসাবেলের আরেকটি প্রকল্পে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে ৫০০ পরিবারকে। তবে তার দাবি, প্রকল্পের সঙ্গে উচ্ছেদের কোনো সংযোগ নেই। উন্নয়ন স্থগিত হওয়ার কারণে তার সংস্থাগুলোকে কোনো অর্থও ধেয়া হয়নি বলে দাবি তার। 

বিলিয়নেয়ার ইসাবেল অ্যাঙ্গোলার টেলিকম শিল্প থেকেও বড় অংকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন সরবরাহকারী ইউনিটেলের ২৫ শতাংশ শেয়ার নেন ইসাবেল। ১৯৯৯ সালে তার বাবা এ প্রতিষ্ঠানটিকে টেলিকম লাইসেন্স দেয়। এর পরের বছরই তিনি সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় আমলার কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেন। ইউনিটেল এরই মধ্যে তাকে ১০০ কোটি ডলার লভ্যাংশ দিয়েছে। এখানে তার শেয়ারের পরিমানও ১০০ কোটি ডলার। এখান থেকে টাকা কামানোর আরেকটি চমৎকার কৌশল করেন ইসাবেল। ইউনিটেল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংস নামে একটি নতুন সংস্থা খুলে ৩৫ কোটি ডলার ধার দেয়ার জন্য ইউনিটেলকে রাজি করান। নতুন কোম্পানির নামে বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ এর কোম্পানির মালিক ইসাবেল, এর সঙ্গে ইউনিটেলের কোনো সম্পর্ক নেই।

এভাবে নানা ফন্দি-ফিকির করে বাবা পদ এবং নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন ইসাবেল দোস সান্তোস। অ্যাঙ্গোলার সরকার সেসব সম্পদের খোঁজখবর করতে শুরু করেছে।

বিবিসি অবলম্বনে উম্মে সালমা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন