যে গ্রামে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয় শিশুরা

দেবাশীষ দেবু, সিলেট

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের আমতৈল গ্রাম। মোট জনসংখ্যা হাজার ৫০০। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষ প্রতিবন্ধী, যার সিংহভাগই আবার শিশু।

এক গ্রামে এত বেশিসংখ্যক প্রতিবন্ধী কেন? এর উত্তর খুঁজতে সিলেটের সিভিল সার্জন, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বণিক বার্তা। সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে না পারলেও বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তারা।

বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুর রহমান মুসা বলেন, এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। গ্রামের পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর। দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, মাতৃকালীন স্বাস্থ্য শিশুস্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে এখানকার অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিচ্ছে। কেউ বা আবার জন্মের পর বিভিন্ন অসুখে ভুগে প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এখানে জন্মহারও অনেক বেশি।

তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি বিভিন্ন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, গ্রামের প্রায় সবাই একে অন্যের আত্মীয়কে বিয়ে করছেন। বংশগত কারণে সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। গ্রামটিতে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের প্রবণতা বেশি। তথ্যের সত্যতাও মিলেছে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে।

নিজের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল গ্রামেরই বাসিন্দা রাজিয়া বেগমের। বিয়ের বছরখানেক পর দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় একটি কন্যাসন্তান। নাম রাখা হয় সুমি বেগম। জন্মের পর থেকেই হাঁটতে পারে না সুমি। তার মা রাজিয়া বেগম বলেন, কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। চিকিৎসা করানোরও সামর্থ্য নেই। তাই মেয়েও সুস্থ হচ্ছে না।

বিশ্বনাথ সিলেটের সবচেয়ে প্রবাসীবহুল উপজেলা। এখানকার বেশির ভাগ প্রবাসীই যুক্তরাজ্যে থাকেন। উপজেলাজুড়েই এর ছাপ রয়েছে। যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা অসংখ্য প্রাসাদসম অট্টালিকা আর বাড়ির সামনে কারুকার্যময় তোরণ জানান দেয় বিশ্বনাথের ঐশ্বর্য। কিন্তু উপজেলারই আশ্চর্য রকমের ব্যতিক্রম গ্রাম আমতৈল। বিশাল গ্রামে পাকা বাড়িই আছে হাতেগোনা কয়েকটি। তার চেয়েও কম আছে নলকূপ। আর স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তো রীতিমতো বিরল।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের গ্রামে গত রোববার সরেজমিন ঘুরে যে চিত্র চোখে পড়েছে তাতে একে গ্রাম না বলে বস্তি বলাটাই ভালো। ভাঙাচোরা সব ঘর একটির গায়ে আরেকটি প্রায় ঠেস দিয়ে আছে। যেখানে সেখানে খোলা পায়খানা, ছালা বা পলিথিনের বেড়া দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে সেগুলো। তবে সে আড়াল ভেদ করে ময়লা ছড়িয়ে পড়ছে সড়কের পাশে। গ্রামের সব পুকুরই এঁদো। আবর্জনার স্তূপ জমে পানি তার রঙ হারিয়েছে। এসব এঁদো পুকুরেই বাসনপত্র ধুচ্ছেন নারীরা। গোসলও করছেন কেউ কেউ।

গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল গনি বলেন, গ্রামে নলকূপ খুবই কম। যেগুলো আছে সেগুলোতেও আর্সেনিক খুব বেশি। তাই গ্রামের লোকজন পুকুরের পানিই ব্যবহার করে। আর গ্রামে স্যানিটারি ল্যাট্রিন খুব একটা নেই। সবাই দরিদ্র মত্স্যজীবী হওয়ায় ল্যাট্রিন বসানোর সামর্থ্য তাদের নেই। তার নিজের ছেলে কুনু মিয়াও (১৮) জন্মের পর থেকে হাঁটাচলা করতে পারে না বলে জানান আব্দুল গনি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য প্যানেল চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেন, দিন দিন এখানে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। চার-পাঁচ বছর আগেও কম ছিল। অথচ সম্প্রতি প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার অনেক বেড়ে গেছে।

বিশ্বনাথ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী শনাক্ত করতে সর্বশেষ ২০১৩ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ করেছিল জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর। এর পর থেকে সমাজসেবা কার্যালয়ে এসেই প্রতিবন্ধীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। কেউ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কার্যালয়ে এনে নাম তালিকাভুক্ত না করালে তাকে গণনায় ধরা হয় না। পর্যন্ত উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী হিসেবে জরিপের আওতায় এসেছে ৫৯৯ জন। জরিপের আওতার বাইরেও কিছু প্রতিবন্ধী থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, ইউনিয়ন তথা পুরো উপজেলার মধ্যে আমতৈল গ্রামেই সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী রয়েছে। জরিপের আওতায় আসাদের মধ্যে ৩৫০ প্রতিবন্ধীই আমতৈল গ্রামের বলে জানিয়েছেন তারা।

তবে আমতৈল গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল খায়ের রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলমগীরের ভাষ্য, গ্রামে প্রতিবন্ধী লোকের সংখ্যা প্রায় ৪০০। এর মধ্যে তিন শতাধিকই শিশু।

শারীরিক প্রতিবন্ধীর পাশাপাশি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীও আছে আমতৈল গ্রামে। গ্রামের মাওলানা আবুল খায়েরের দুই ছেলে রাফি মিয়া () সাফি মিয়া () তারা হাঁটাচলা করতে পারে না, কথাও বলতে পারে না। জন্মের পর থেকেই শিশু দুটি এমন সমস্যায় ভুগছে।

নিজের ছেলেদের ব্যাপারে মাওলানা আবুল খায়ের বলেন, যে বয়সে এসে ছেলেরা সাধারণত হাঁটতে শেখে, সেই বয়সে এসে দেখি আমার ছেলেরা উঠে বসতেও পারে না। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও কথা ফোটেনি তাদের মুখে। ছেলেদের নিয়ে সিলেট ঢাকায় অনেক চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।

আবুল খায়ের ছেলেদের নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে গেলেও সে সামর্থ্য নেই আব্দুল মতিনের। আব্দুল মতিনের মেয়ে মৌসুমী বেগম বছর ১৮-তে পা দিয়েছে। এখনো কোলে তুলে তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হয়। জন্মের পর কোনোদিনও হাঁটতে পারেনি মৌসুমী।

আব্দুল মতিন বাড়ি বাড়ি ফেরি করে শুঁটকি বিক্রি করেন। দুই ছেলে এক মেয়েসহ পাঁচজনের পরিবার তার। তিনি বলেন, পরিবারের খাওয়া খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। মেয়ের চিকিৎসা করাব কী করে।

শুধু আবদুল মতিন নন, মত্স্যজীবী অধ্যুষিত গ্রামে আরো অনেকেই আছেন যাদের দুই বেলা খাবার জোটাতে কষ্ট হয়। দারিদ্র্য অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে অর্থাভাবে নিজের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করাতে পারেন না তারা।

ব্যাপারে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডল বলেন, এক গ্রামে এতসংখ্যক প্রতিবন্ধী থাকা খুবই আশঙ্কাজনক খবর। পুষ্টিহীনতা কিংবা আয়রনের অভাবে এমনটি হতে পারে। তবে আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। তাই সঠিক কারণটি বলতে পারব না। এজন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এখানকার প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতি মাসে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের প্রায় অর্ধেকই সরকারি ভাতা পায়। আর ৮০ শতাংশের প্রতিবন্ধী কার্ড আছে। বিষয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের বলেন, গ্রামটির ব্যাপারে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও অবগত আছে। এখানে প্রতিবন্ধী ভাতাও বেশি দেয়া হয়। আমতৈল গ্রামে প্রায় ২৫০ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন