প্রতিষ্ঠান বড় ও কাজের পরিধি বিস্তৃত করাই হবে লক্ষ্য

আসিফ সালেহ, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ২০১১ সালে ব্র্যাকে যোগদানের পর সামাজিক পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ সামাজিক উদ্ভাবনে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠানটির কৌশলগত দিকনির্দেশনায় তার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। স্যার ফজলে হাসান আবেদ-পরবর্তী ব্র্যাকের কার্যক্রম, চ্যালেঞ্জ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর আমাদের মাঝে নেই। আপনি দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে কাজ করেছেন। কেমন দেখেছেন তাকে?

বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে অনেকেই স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন তারা। আমি তাঁর চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনালোচিত দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব। স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বাতন্ত্র্য-অনন্যতার বিভিন্ন ধরন আছে। তিনি ব্যবস্থাপক হিসেবে কেমন ছিলেন, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন এবং সংগঠনের নেতা হিসেবে কেমন ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্র্যাক একটি সমন্বয়ধর্মী (হাইব্রিড) সংগঠন। এখানে একদিকে সামাজিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা বা উদ্যোগ (এন্টারপ্রাইজ) পরিচালনা করতে হয়। কাজেই ব্র্যাকের নেতৃত্বের দ্বিমুখী দক্ষতা থাকা দরকার। তবে তারও একটি স্বতন্ত্র মাত্রা (ডাইমেনশন) আছে।

প্রথমত, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্যবস্থাপক হিসেবে অসম্ভব বিস্তৃতমুখী (ডিটেইলড ওরিয়েন্টেড) ছিলেন। তিনি ব্র্যাকের বিভিন্ন বিষয়ের গুণগত মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। সংগঠন হিসেবে ব্র্যাককে নাম্বার ওয়ানে উন্নীত করার প্রতি সবসময়ই জোর দিতেন। তিনি নিশ্চিত করতেন আমাদের মানদণ্ড (স্ট্যান্ডার্ড) যেন অনেক উঁচু থাকে। আশপাশে কী হচ্ছে তা না দেখে আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেন মানদণ্ড ঠিক করি। মানদণ্ড পরিপূরণে তিনি কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিতেন। পাশাপাশি কাজটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা সঠিকভাবে তদারক করতেন। তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ওপর; যাতে তদারকি, গবেষণা বাস্তবায়নের সম্মিলনে মানসম্পন্ন টেকসই কর্মসূচি পরিচালনা করা যায়। কারণে ব্র্যাকের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মিলেছে; অনেক দেশে পদার্পণ এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যথাযথ বাস্তবায়ন (প্রপার এক্সিকিউশন) প্রক্রিয়া ভালোভাবে কাজ করেছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অমর্ত্য সেন স্যার আবেদের বিষয়ে একটি কথা বলেছেন; আমার মনে হয় সেটি যথার্থ। তিনি বলেছেন, ক্লিয়ার হেডেড থিংকিং অ্যান্ড সিওর ফুটেড এক্সিকিউশন তাঁর মধ্যে ছিল পরিষ্কার চিন্তা করার নিশ্চিত বাস্তবায়নের যৌথ সম্মিলন এবং তিনি স্বপ্নদর্শী (ভিশনারি) ছিলেন। তিনি ১৫-২০ বছর পরের দৃশ্যপট পরিষ্কারভাবে দেখতে চিন্তা করতে পারতেন। অনেক মানুষের অনেক বড় বড় ধারণা (আইডিয়া) আছে। কিন্তু ধারাবাহিক বাস্তবায়ন করতে পারেন না। আবার অনেকের বাস্তবায়ন বা পরিচালন দক্ষতা খুব ভালো। কিন্তু তাদের আবার ভিশন নেই। তাঁর ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের একটি অভিনব সম্মিলন ছিল। তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।

দ্বিতীয়ত, সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি জানতেন, তাঁর আকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি বা ইভেন্ট একা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে সামষ্টিক নেতৃত্বের (কালেক্টিভ লিডারশিপদরকার হবে। তিনি সবসময় চাইতেন সংগঠনে তরুণ প্রজন্মের (নিউ ব্লাড) সম্মিলন ঘটাতে। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা তৈরি করতে। বিষয়টির প্রতি তাঁর সবসময় নজর ছিল। আজকে ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে ভালো দক্ষ কর্মী-সংগঠক বাহিনী আছে এটি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয়, এটি তাঁর প্রত্যক্ষ অবদান। তিনি বিদেশে গেলে দক্ষ সক্ষম ব্যক্তিদের বাংলাদেশে এসে ব্র্যাকে কাজ করার আহ্বান জানাতেন।

আমার কথাই ধরা যাক। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৮ সালে লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে। তাঁকে একটা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল সেখানে। সেখানে তাঁর বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপের সুযোগ ঘটেছিল। তিনি বলেছিলেন দেশে অনেক কিছু কাজ করার আছে। আপনি দেশে এসে কাজ করতে পারেন। এটা আমার মনে সাড়া ফেলেছিল। ২০০৯ সালে দেশে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলাম। সংশ্লিষ্ট বিভাগে কার্ড দিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন পরই তাঁর সহকারী আমাকে দেখা করার জন্য ফোন করেছিলেন। আমি অবাক হয়েছিলাম। তিনি আমার জন্য আধা ঘণ্টা সময় রেখেছিলেন। কিন্তু বৈঠকটি দেড় ঘণ্টা গড়িয়েছিল। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি কাজ করার বাসনায় আমি সেবার দেশে এসেছিলাম। আমি পরিকল্পনাটা তাঁকে বলেছিলাম। তিনি মন দিয়ে পুরোটা শুনেছিলেন, নিজের মন্তব্য সংযোজন করেছিলেন, বলেছিলেন ব্র্যাক ব্যাংক ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারে। একজনকে ফোন করে বলেছিলেন, একজন ছেলে এসেছে তুমি তার সঙ্গে একটু দেখা করো। সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছিলেন রুমি আলী। তিনি আবার ব্র্যাক ব্যাংকে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমি এতে খুব অবাক হয়েছিলাম যে, আমি ক্ষুদ্র একজন মানুষ, ছোট একটি উদ্যোগ নিয়ে এসেছি, এটি সফল হবে কিনা কোনো নিশ্চয়তা নেই, তিনি আমাকে দেড় ঘণ্টা সময় দিলেন, মন দিয়ে কথা শুনলেন, আবার স্বল্প সময়ে অন্যদের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিলেন। তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতার শুরু সেখান থেকেই।

ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশের অনেক নতুন সংগঠনকেও সহায়তা করেছেন। যেমন বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি), পিস ফর বাংলাদেশ। সংগঠনটির কর্ণধারের কথা শুনে তাঁর ভালো লেগেছিল। বলেছিলেন, তাদের এখনো নিজস্ব ভবন নেই। সেগুলো ঠিকঠাক করুক। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব তৈরি করা খুব দরকার। তিনি সহজেই অর্থ দিয়েছিলেন। তিনি আরো অনেককেই এমন সহায়তা করেছেন। কিন্তু এসবের জন্য তিনি প্রচার-প্রচারণা প্রাপ্তির তোয়াক্কা করতেন না। নতুনের প্রতি আগ্রহ, নতুন আইডিয়ার প্রতি আগ্রহ এবং ইনোভেশনের প্রতি স্যার আবেদের প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। তিনি মনে করতেন এসব বিষয়কে সমর্থন করা দরকার। আক্ষরিক অর্থে সামাজিক উদ্যোক্তা বলতে যা বোঝায়, তিনি তা- ছিলেন। তিনি অন্য সামাজিক উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতেন। এটি তাঁর সাংগঠনিক নেতৃত্বের একটি অনন্য গুণ।

তাঁর চরিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক অনেকেই জানেন না। এনজিও জগতের অনেক নেতাই আছে সংগঠনের ভালো চায়, ভালো ভালো কথা বলেন; তবে সংগঠনের ভবিষ্যৎ বেশি দূর পর্যন্ত দেখতে পান না; দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে পারেন না। তাঁর মধ্যে দুটোরই সম্মিলন ঘটেছিল। এক. তিনি সব সময়ই পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করতেন এবং দুই. তিনি অসম্ভব ভালো কর্মসূচি ডিজাইন করতে পারতেন। তিনি অসংগতি বা ব্যবধানগুলো (গ্যাপ) চিহ্নিত করতে পারতেন। ব্যবসায়ীরা যেমন গ্যাপ দেখে একটি পণ্য বাজারে প্রবর্তন করে, সেটিকে পুঁজি করে অর্থ বানায়, তিনিও সেটি পারতেন। তিনি সামাজিক ব্যবধানগুলো দেখেছিলেন এবং হস্তক্ষেপ করে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর সামাজিক উদ্যোগগুলো নেয়া। একই সঙ্গে দেখিয়েছেন সেগুলোয় কীভাবে সফল হওয়া যায়। এসএমই ব্যাংকিংয়ের কথা বলা যাক। ব্র্যাক ব্যাংক শুরু হয়েছিল এসএমই ব্যাংকিং দিয়ে। এক্ষেত্রে তার প্রধান প্রণোদনা ছিল ক্ষুদ্রঋণ যেসব এসএমইকে সাপোর্ট করতে পারছে না সেগুলোকে বাড়তি প্রণোদনা দেয়া এবং তার জন্য একটি আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এসএমইকে বাড়তি সমর্থন দিয়েও যে ব্যাংককে লাভজনক করা যায়, সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে। মানবিক কর্মসূচি ডিজাইন করার ক্ষমতা এবং ব্যবসা পরিচালন ক্ষমতার সমন্বয় বিরল। ব্যবসাকে ভালো কাজে লাগালে বৃহত্তর জনকল্যাণ যে নিশ্চিত করা সম্ভব, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। এটা তার বিরাট গুণ দক্ষতা।

তৃতীয়ত, মানুষ হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ কেমন ছিলেন। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষকে কীভাবে দেখা উচিত, কীভাবে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হয় প্রভৃতি বিষয়েও তাঁর অনন্য অনির্বচনীয় গুণ ছিল। তাঁর মধ্যে মানুষের প্রতি অদ্ভুত সহমর্মিতা (এমপ্যাথি) ছিল। কথা কম বলে, কাজের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তৈরি করতেন তিনি। বড় কথা, পিছিয়ে পড়াদের প্রতি তাঁর অন্য রকম টান ছিল। নারীদের প্রতি তাঁর বিশেষ একটা সফট কর্নার ছিল। তিনি মাকে হারিয়েছিলেন তুলনামূলক অল্প বয়সে, যাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তিনি বোনদের হারিয়েছিলেন, বোনরা কেউ ত্রিশের ঘরে পৌঁছতে পারেননি। অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন সন্তান জন্মদানকালে। তারপর স্ত্রীও মারা গিয়েছিলেন সন্তান জন্মদানজনিত জটিলতায়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নারীরা যাতে মারা না যায়, সেজন্য তিনি বিশাল কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন এবং সেটি সফলও হয়েছে। তারপর নারী-পুরুষের সমতাকে তিনি বলেছেন নিজেরআনফিনিশড এজেন্ডা লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি তিনি ভেতর থেকেই অনুভব করতেন। ব্র্যাকের মধ্যে নারী নেতৃত্ব তৈরি করা, নারীদের জন্য বিশেষায়িত কর্মসূচি ডিজাইন করাএসবে তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

মানুষ হিসেবে তাঁর আরেকটি বড় গুণ হলো, তিনি খুব কৌতূহলী ছিলেন। সবসময় চিন্তা করতেন। যাদের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করছেন তাদের দৃষ্টিকোণ (পয়েন্ট অব ভিউ) থেকে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প ডিজাইন করতেন। তিনি সবসময় মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করতেন। মাঠে তিনি প্রচুর সময় কাটাতেন। তিনি শহরে বড় হয়েছেন বটে, কিন্তু ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক দিনগুলোয় মাসের মধ্যে মাঠে-গ্রামে ১৫-২০ দিন পর্যন্ত থাকতেন। সেখানে সবার সঙ্গে কথা বলতেন।

মানুষের ক্ষমতা-সক্ষমতার প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, সব মানুষই পারে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়ারা বঞ্চিত থাকে, কারণ তারা পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতি থেকে তাদের বের করার উপায় হলো তাদের দুয়েকটি টুলস দেয়া। সেসব টুলস ব্যবহার করে তারা সেখান থেকে উঠে আসবে। সেই টুলসগুলো কী হবে সেটি নিয়ে তিনি অব্যাহতভাবে চিন্তা করতেন। তিনি মনে করতেন আন্তঃপ্রাজন্মিক দারিদ্র্য থেকে বেরোনোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেন। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে তিনি একমাত্র ম্যাজিক বুলেট ভাবতেন না, কিন্তু মনে করতেন এটি উত্তরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেক্ষেত্রে মাইক্রোফিন্যান্স বলি, আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম বলি, ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট তৈরি করাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা এসেছিল মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ, কৌতূহল এবং মাঠে যে প্রচুর সময় কাটাতেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন সেখান থেকে।


ব্র্যাক নিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন কী ছিল?

স্যার আবেদ সবসময় বলতেন ব্র্যাক হবে একটি সামাজিক সংগঠন, যেটি সামাজিক সমস্যার সমাধান করবে। যে সময়ে যে সমস্যা উদ্ভত হবে তার সমাধান করবে। সারা সময়ই ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডগুলোকে প্রাসঙ্গিক সময়োপযোগী পাওয়া যাবে। প্রাসঙ্গিক থাকার একমাত্র উপায় হলো, যে সমস্যা বর্তমানে সবচেয়ে প্রগাঢ় থাকে সেটি নিয়ে কাজ করা। তিনি সামাজিক সমস্যা সমাধানে গবেষণা উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছেন।

সাধারণ কোনো এনজিওতে সাধারণত একটি প্রকল্প প্রস্তাব (পিপি) লেখা হয়। দাতারা তহবিল জোগান দেবে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প। কিছু কর্মকাণ্ড দেখাবে। কর্মকাণ্ডগুলো সম্পন্ন হলে প্রকল্প শেষ। আবার নতুন প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়। আউটকাম বা সুফলগুলো এল কি এল না, তা আর দেখা হয় না। সেদিক থেকে ব্র্যাক কিন্তু ভিন্ন ধরনের। ব্র্যাক প্রজেক্টভিত্তিক চিন্তা না করে কৌশলভিত্তিক চিন্তা করে। আমাদের আরেকটু দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হয়। আমাদের প্রতিটি প্রোগ্রামের একটি স্ট্র্যাটেজি আছে। স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে গিয়ে একসঙ্গে তিন-চারটি বিষয় আমাদের ভাবতে হয়। কারণ আমরা জানি না কোন বিষয়টি কাজ করবে। তাই দেখা যায়, একই সঙ্গে আমরা চার-পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প কর্মকাণ্ড করছি, একই সঙ্গে আমরা বেশকিছু পাইলটিং করছি। কোনটি কাজ করছে সেটি বোঝার জন্য গবেষণা করতে হয়। যেমন আমাদের এখন একটা স্কিলস প্রোগ্রাম চলছে। আমরা ইচ্ছা করলে সাধারণ একটা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করতে পারতাম, যেটি হবে গতানুগতিক। আমরা চিন্তা করেছি যে, ৮৫-৮৭ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে। আমাদের সেখানেই বেশি কাজ করতে হবে। আমরা একটি মডেল তৈরি করেছি অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষদের কীভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। সেখান থেকে দু-তিনটি মডেল বের হচ্ছে। আরেকটু ভিন্ন বয়সগোষ্ঠীর জন্য, ভিন্নভাবে টার্গেটিং করে, সুনির্দিষ্ট খাত লক্ষ্য করে। রকম অসংখ্য পাইলটিং করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার সমাধান বের করা। পাঁচটি পাইলটিংয়ের মধ্যে হয়তো তিনটি কাজ করবে না। দুটি কাজ করবে। ওই দুটিকে আমরা কীভাবে বড় করব, সেটিই থাকে মনোযোগের কেন্দ্রে। তিনি সেভাবেই সার্বিক বিষয় দেখতেন।

অন্যান্য এনজিও থেকে ব্র্যাকের কাজ চিন্তার পার্থক্য কোথায়?

ব্র্যাকে আমরা চিন্তা করি যে, ব্র্যাক একসময় না থাকলেও যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা-সামর্থ্য তৈরি হয়। যাতে ব্র্যাক না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কাজের প্রভাবটা মানুষ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একটি ছোট উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুলগুলোয় আমরা বাইরে থেকে কোনো শিক্ষক নিয়ে যাই না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যে নারী বাসায় বসে আছেন এসএসসি বা এইচএসসি পাস করে তাদের নিয়োগ দিই। তাদের প্রশিক্ষণ দিই। এতে দুটো লাভ হয়। এক. তাদের নিজের জনগোষ্ঠীর প্রতি অন্য রকম টান থাকে। বাবা-মা নিরাপদ বোধ করেন। দুই. পাশাপাশি তার দক্ষতা বাড়ে। তারপর ব্র্যাকের স্কুল যদি বন্ধ হয়ে যায়, যেহেতু একটি স্কুল চার বছর মেয়াদি থাকে, তখন ওই শিক্ষক স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সমাজে তার একটা অবস্থান তৈরি হয়ে যায়। তার মানে, সে নিজের জনগোষ্ঠীর সেবা করছে। তার দক্ষতা তৈরি হচ্ছে এবং নারীরা যারা পিছিয়ে পড়েছিল তারা শিক্ষক হয়ে আসছে। এখন সরকারিভাবেও প্রাথমিক পর্যায়ে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগের বিধান চালু করা হয়েছে।

আমাদের অ্যাপ্রোচ হলো, কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো; যাতে আমরা চলে গেলে তারা নিজেদের স্থানীয় সম্প্রদায়কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কারণেই উগান্ডায় আমরা ভালো করছি। কারণেই অন্যান্য দেশে আমরা ভালো করছি। উগান্ডায় ব্র্যাকের চার হাজার কর্মী আছেন। তার মধ্যে ৯৮ শতাংশই উগান্ডার লোক। মাত্র গুটিকয়েক আছে বাংলাদেশের। কারণ উগান্ডার সমস্যা সেখানকার জনগোষ্ঠী ভালো সমাধান করতে পারবে। অন্য দেশেও তাই। আমরা যদি অ্যাপ্রোচে ভালোভাবে এগোতে পারি, তাহলে এটি বৈশ্বিক উন্নয়ন ডিসকোর্সে ভালোভাবে জায়গা করে নেবে। এজন্য পশ্চিমা এনজিওগুলো কিছুটা আমাদের হুমকি হিসেবে দেখে। কারণ তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনেকটা তাত্ত্বিক। আর আমরা একদম মাঠে কাজ করি। আমাদের জ্ঞানগুলো মাঠ থেকে উঠে আসে। সেক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা-জ্ঞানের যথার্থতা বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি হবে। আমরা যদি এটিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি স্বাভাবিকভাবে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকবে।

 ব্র্যাকের শক্তিশালী দিক কোনটি বলে আপনি মনে করেন, যা সংস্থাকে আজ বিশ্বের এক নম্বর এনজিওতে পরিণত করেছে?

ব্র্যাকের একটি শক্তিশালী দিক হলো, এটি প্রাতিষ্ঠানিকতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি আমাদের প্রতিষ্ঠাতার বিচক্ষণতা। স্যার আবেদ সবসময় প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দিয়েছেন ব্যক্তি ইমেজের তুলনায়। আমরা অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখি যে, ব্যক্তিগত প্রোফাইল এত বেশি হয়ে যায় যে সংগঠনের চেয়ে ব্যক্তি বেশি প্রাধান্য পায়। তিনি সবসময় চেয়েছেন ব্র্যাককে তুলে ধরতে, প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিনিধিত্ব করতে। আমি বৈশ্বিক পর্যায়ে নানা সময়ে ব্র্যাকের প্রতিনিধিত্ব করেছি। দেখেছি যে, ব্র্যাকের চেয়ে আবেদকে কম লোকে চেনে। তিনি এটি ইচ্ছাকৃতভাবে (ডেলিবারেটলি) চেয়েছিলেন। কারণ তিনি চিন্তা করেছেন, এক সময় ফজলে হাসান আবেদ থাকবেন না, কিন্তু ব্র্যাক থাকবে।

স্যার আবেদ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধির কথা যেমন বলতেন, পাশাপাশি সংগঠনের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির কথাও বলতেন। এজন্য ব্র্যাক কর্মীদের বিদেশে পড়তে পাঠানো, বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ করিয়ে নিয়ে আসা প্রভৃতিতে তিনি সবসময় অনেক খরচ করতেন। আমাদের অনেক নেতা যারা তৈরি হয়েছে, যারা অনেক বছর ধরে কাজ করেছেন, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিদেশ থেকে পড়িয়ে নিয়ে আসা এগুলো সব ব্র্যাক করেছে। কারণ ব্র্যাক সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করে, চূড়ান্তভাবে সামষ্টিক নেতৃত্ব (কালেক্টিভ লিডারশিপ) তৈরি করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে দক্ষতা অনেক বাড়ানো চাই।

 ব্র্যাকের কর্মসূচির বিবর্তন কীভাবে হতো?

ব্র্যাকে যেন সবসময়ই সমস্যা সমাধানের একটি সংস্কৃতি চালু থাকে তিনি তা চাইতেন। গত শতকের সত্তরের দশকে আমাদের মনোযোগ ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ। আশির দশকে ছিল টিকাদান কর্মসূচি এবং মাতৃ শিশুমৃত্যু কমানো। নব্বইয়ের দশকে ছিল শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে আসা। রকম বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন বিষয় বড় করেছি। এখন হাতে নিয়েছি তরুণ প্রজন্মের আত্ম উন্নয়নের কাজ। এখন দেখছি যে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে ব্র্যাককে বড় কাজ করতে হবে। আগামী দশকগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন প্রাধান্য পাবে। এখানে কোনো মডেল তৈরি করা যায় কিনা, সেটি নিয়ে কাজ করব। মোদ্দা কথা হলো, তিনি তার মূল্যবোধগুলো আমাদের সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে দিয়ে গেছেন। পাশাপাশি আমাদের কিছু অ্যাপ্রোচ শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এগুলোকে শক্ত খুঁটি হিসেবে ধরে নতুন নতুন ক্ষেত্রে আমরা আগামী দিনগুলোয় কাজ করব। কিন্তু খুঁটিটা হবে তার শেখানো অ্যাপ্রোচ এবং তাঁর মূল্যবোধ।

 ব্র্যাক পরিচালনায় স্যার আবেদ কীভাবে যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে দক্ষ জনবলের সমন্বয় করতেন?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ সবসময় বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে চাইতেন। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ এবং অনুন্নত দেশ হিসেবে ছিল অনেক দিন। সেক্ষেত্রে আশপাশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুসরণ করে মানদণ্ড ঠিক না করে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে হবে। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের জায়গায় নিতে হলে ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে ওই জায়গায় নিতে হবে অন্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানকে যদি সম্পূর্ণভাবে বিন্যাস করতে হয়, তাহলে বাইরে থেকে নিয়মিত তরুণ প্রজন্ম সংযোজন করতে হবে। এটি না হলে একটি প্রতিষ্ঠান স্থবির হয়ে যাবে। এটি তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।

স্যার আবেদ চেয়েছিলেন প্রযুক্তি বোঝে এমন লোক ব্র্যাকে যেন থাকে। এজন্য তিনি অনেক কম বয়সে আমাকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অনেকেই অবাক হয়েছিল। কেন এটি হলো? তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক নেতৃত্বে ওই ক্যাপাসিটির লোক নেই। আমাকে নিয়ে এলে সেটি পূরণ হবে। আমি প্রথমে কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করেছি। সোস্যাল ইনোভেশন নিয়ে কাজ করেছি। তিনি আমাকে নতুন প্রোগ্রাম তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরে প্রযুক্তির ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। প্রথম কম্পিউটার ব্র্যাকে এসেছিল আশির দশকের শেষে। ব্র্যাক নেট বাংলাদেশের প্রথমদিকের নেট সার্ভিস প্রোভাইডার। তিনি বুঝতেন যে চূড়ান্তভাবে প্রযুক্তি প্রভাব বিস্তার করবে। কিন্তু তিনি এটি জানতেন তার সে দক্ষতা নেই। স্মার্টফোন কেবল তিন-চার বছর আগে নিয়েছিলেন তিনি। এটি বুঝেছিলেন যে, নিজের সক্ষমতা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য-সক্ষমতা যদি থাকে, তাহলে ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল হবে। এজন্য মেধাবী লোকদের নিয়ে আসতেন।

 স্যার আবেদ যে ক্ষেত্রে হাত দিতেন তাতেই সফল হতেন, এর রহস্য কী ছিল?

ফজলে হাসান আবেদের চরিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ধারাবাহিক সফলতা। তিনি যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন সবগুলোতেই তিনি সফল হয়েছেন। সফলতার পেছনে কয়েকটি অনুঘটক কাজ করেছে। এক. চ্যালেঞ্জগুলোর সঠিক শনাক্তকরণ। এটি প্রতিটি সিইওকে করতে হয়। তার সব সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। কিন্তু তার সফলতা অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো নিয়মিত মেধাবীদের নিয়ে আসা, অন্বেষণ করা। বোঝা, কে ভালো করতে পারবে। দুই. তাঁর চিন্তা খুব পরিষ্কার ছিল। সেজন্য তিনি সুস্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারতেন। মানদণ্ড নির্ধারণ করে তিনি তা ছেড়ে দিতেন না। সেগুলো ঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তাদের নির্দেশনা, তদারকি থাকত। চূড়ান্তভাবে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সারাক্ষণ বইপত্র পড়তেন। একটি ল্যাট্রিন বা নলকূপ তিন ফুট হবে না চার ফুট হবে, তাও মনে থাকত। তিনি বিষয়ও পরিষ্কার করে বুঝতেন। তিনি আড়ংয়ে গিয়ে এর কাপড়ের গুণগত মান নিয়মিত চেক করতেন। পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক যখন প্রতি মাসে তার স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) উপস্থাপন করছে, তখন এসএমইতে কেন আমরা খারাপ করছি সেই বিষয়গুলো বোঝা এবং তার ভেতরে সবিস্তারে ঢোকা, কী করলে ভালো হবে, তার পরিষ্কার নির্দেশনা থাকত। এক্ষেত্রে তাঁর নলেজ আনপ্যারালাল। আমি বলব না যে এটি একজন নেতৃত্বের কারণে হয়েছে। তাঁর নেতৃত্ব গুণ ছিল ভালো; সামষ্টিক নেতৃত্বও ভালো ছিল। ঠিক সময়ে হস্তক্ষেপ করা, ঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা (রাইট গাইডেন্স) দেয়ার সক্ষমতা ছিল তাঁর এবং প্রতিটি বিষয়ে তাঁর ব্যাপক জ্ঞান প্রজ্ঞা ছিল।

তিনি আড়ং স্থাপন করেছেন। কিন্তু এর জন্য গতানুগতিক কারখানা করেননি। তিনি তাঁতিদের কাছ থেকে, ক্ষুদ্র কারিগরদের কাছ থেকে কাপড়-পোশাক এবং অন্যান্য পণ্য আউটসোর্স করেছেন। তার উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার, বিভিন্ন প্রান্তের পেশাজীবী, কারিগরদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা। এজন্য আমাদের ডেলিভারি কস্ট অনেক বেশি। তিনি খুব পরিষ্কার। কেন তিনি আড়ং স্থাপন করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর চিন্তা পরিষ্কার। আড়ং স্থাপন শুধু ব্যবসা বাড়ানো নয়, এর উদ্দেশ্য কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। অনেক সাব-সেন্টার আছে নীলফামারীসহ নানা জায়গায়। যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একটা বড় উদ্দেশ্য। বড় উদ্দেশ্য ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা, আর্টিজানদের বাঁচিয়ে রাখা। এজন্য আমাদের ডেলিভারি কস্ট অনেক বেশি। আমরা ঢাকার আশপাশে কারখানা প্রতিষ্ঠাপূর্বক আড়ংয়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারতাম। এতে সরবরাহ ব্যয় কমে আসত। কিন্তু তিনি পরিষ্কার তিনি কী চান। তিনি তাঁতিদের, কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে চান। চূড়ান্তভাবে আড়ংয়ের মডেল খুব বেশি রবিনহুড মডেল। তিনি তখনই বলেছিলেন, এটি তিনি বড় লোকদের টার্গেট করে করেছেন। বড়লোকরা কিনবে। এখন অনেক দাম-স্তরের (রেঞ্জের) পণ্য আছে। মধ্যবিত্তদের আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আড়ংয়ের নতুন নতুন ব্র্যান্ড হয়েছে। একদিকে বিক্রেতা মোটামুটি নিশ্চিত যে তার জীবিকার সংস্থান হবে। কারণ তার একটা সুনিশ্চিত ক্রেতা (গ্যারান্টেড বায়ার) আছে। আমরা কিনে নিচ্ছি। পাশাপাশি যদি ভালো বিপণন (মার্কেটিং) করতে পারি, আকাঙ্ক্ষা/চাহিদা তৈরি করতে পারি, তাহলে বিক্রি করে যে মুনাফা হবে তা আমাদের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সাহায্য করতে পারব এবং আড়ংয়েরও আরো বিস্তৃতি ঘটবে। ৬৫ হাজার আর্টিজানকে আমরা এখন সাপোর্ট করি এবং সামনে ৯০ হাজারকে করব। কাজেই এদিক থেকে তিনি খুবই পরিষ্কার।

ব্র্যাক যখন প্রথম ভবন করল বা প্রথম আড়ং প্রতিষ্ঠা করল অনেক সমালোচনা এসেছে, ব্র্যাক কেন ব্যবসা করছে, এনজিও হয়ে ব্র্যাক কেন এত বড় ভবন করল। এসব সমালোচনা তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না, গায়ে লাগাতেন না। চূড়ান্তভাবে তিনি জানতেন যে তার ভিশন খুব স্পষ্ট। জানতেন যে তিনি সঠিক কাজই করছেন। তিনি জানতেন যে মানুষ একদিন বুঝবে। তিনি শেষ সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, নন-প্রফিট সংগঠনের ধারণা মানুষ অত পরিষ্কারভাবে বোঝে না। কিন্তু কাজগুলো চূড়ান্তভাবে জনগণের জন্য হবে; বাংলাদেশের জন্য হবে।

 ব্র্যাকের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আপনার পরিকল্পনা কী?

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, স্যার আবেদ শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে আর নেই। এখন আমাদের প্রধান করণীয় হলো, তিনি যে মূল্যবাধ, নেতৃত্বের ধরন, সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়েছেন, সেগুলো বজায় রাখা এবং এগুলোর উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটানো। তিনি শেষ সাক্ষাত্কারে ব্র্যাক আরো বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তিনি নতুনদের নেতৃত্বের ভার অর্পণ করেছেন। শেষ বিচারে আমাদের প্রথম কাজ হবে তার মূল্যবোধ, কর্মকৌশল, তার নেতৃত্বের নির্যাস-সারবত্তা (লিডারশিপ এসেন্স) সেটিকে আত্তীকরণ (ইন্টারন্যালাইজ) করা। এটি এক নম্বর প্রাধিকার। দুই নম্বর প্রাধিকার হলো, চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠান আরো বড় করা, কাজের পরিধি আরো বিস্তৃত করা। তার দেয়া দিকনির্দেশনায় বলেছেন যে, ব্র্যাককে প্রাসঙ্গিক হতে হবে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা থেকে চিন্তা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে নতুন নতুন সমস্যা আবির্ভূত হচ্ছে। সেগুলো সমাধানে মডেল তৈরি করতে হবে এবং সেগুলো স্কেল আপে চিন্তা করতে হবে। এটি নয় যে, ব্র্যাক নিজেই স্কেল আপ করবে। সেটি সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বও (পার্টনারশিপ) হতে পারে। সরকারকে প্রভাবিত করেও স্কেল আপ হতে পারে। সরকারের কর্ম প্রকল্পে নিজের মডেলের ভালো দিকগুলোকে যদি আমরা ঢোকাতে পারি, এটি একটি বড় অর্জন হতে পারে। আমাদের লক্ষ্য এটি যেমন আছে; তেমনি জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং ১০-১২ শতাংশ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণ ঘটানো, পাশাপাশি নারী-পুরুষের সমতার মতো কয়েকটি বিষয় রয়েছে। তিনি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে স্পষ্টভাবে বলেছেন এবং এগুলো নিয়ে অবশ্যই কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালকে এগিয়ে নিতে হবে, কারণ সেখানে দরিদ্র মানুষ অনেক বেশি। সেখানে আমাদের একটা ১০ বছর মেয়াদি কর্মকৌশল তৈরি হয়েছে, যেখানে আমরা চাইছি মানুষের কাছে ব্র্যাকের সার্ভিস নিয়ে যেতে। সেক্ষেত্রে আফ্রিকাসহ আরো দরিদ্র দেশগুলোতে যেতে হবে। পাশাপাশি তিনি দেখিয়ে গেছেন, আর্থিকভাবে সংগঠন-প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী রাখা এবং স্বনির্ভর করা। এটি একটি বড় লক্ষ্য। কিছু কিছু গ্র্যাজুয়েশন মডেলের মতো টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স তৈরি করা, যেখানে আমরা অন্যান্য দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারি। [চলবে]

 শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন