মাত্র ৫৬ বছর জীবনের অধিকাংশ সময়ই মঞ্চের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ছিলেন ইশরাত নিশাত। অভিনয়ের নিপুণতা প্রকাশে তার যে সক্ষমতা ছিল, তা দিয়ে চোখ বন্ধ করেই তিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তারকা অভিধাটিকে আলিঙ্গন করতে পারতেন। কিন্তু মঞ্চের পেছনটাকে বেছে নিয়ে সেখানেই তিনি তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন, অগোচরে থেকেও কাছের মানুষদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন আরো কাছের। মঞ্চজীবনে চলার পথে নিশাতের এ রকম কয়েকজন সুহূদ ও বন্ধুর কাছ থেকে শোনা যাক তাকে নিয়ে মূল্যায়ন। গ্রন্থনা করেছেন রুবেল পারভেজ
ইশরাত নিশাত। মঞ্চের পেছনে কাজ করতেন বলে সাধারণ মানুষের কাছে অতটা পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু দেশের নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। যেকোনো বিষয়ে স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দেয়ার জন্য মঞ্চপাড়ায় তিনি ‘বিদ্রোহী কণ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রোববার রাতে এ মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। গতকাল সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে সমাহিত করা হয়।
ইশরাত নিশাত প্রয়াত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ারের সন্তান। তার পিতা কবি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক মুস্তাফা আনোয়ার। নিশাত ‘দেশ নাটক’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চে একাধারে অভিনেতা, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। মঞ্চের পাশাপাশি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তার কণ্ঠ ছিল সোচ্চার।
‘মঞ্চকেই সংগ্রামের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিশাত’
মলয় ভৌমিক, শিক্ষক, নাট্য সংগঠক
আমরা একসঙ্গে মুক্ত নাটকের কাজ করেছি দীর্ঘদিন। নিশাত শিল্পী পরিবারের মানুষ। তার মা বিখ্যাত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ার। তিনি আরণ্যক নাট্যদলে থাকাকালেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি টেলিভিশন ও মঞ্চে অসাধারণ অভিনয় করতেন। এরপর ১৯৮৪ সালে যখন মুক্ত নাটক প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন অনুশীলন নাট্যদল ও আরণ্যক এ দুটি সংগঠন মুক্ত নাটকের কাজে যুক্ত হয়। ওই সময় নারী কর্মীরা বাইরে কাজ করতে গেলে নানা সংকটে পড়তেন। কিন্তু তিনি অদম্য সাহস দিয়ে গ্রামে গ্রামে কাজ করেছেন। বিশেষ করে, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় তার সঙ্গে আমার কাজের সূত্রে যোগাযোগ হয়েছে।
যখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল হয়ে গেল, সবাই যখন মোহে পড়ে পর্দার দিকে চলে গেলেন তখন অসম্ভব দক্ষ অভিনয়শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মঞ্চকেই তার সংগ্রামের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এ বিষয়টিই তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। মঞ্চের পেছনের যে কাজগুলোয় লোকে যেতে চায় না, পরিশ্রমসাধ্য মনে করে, তিনি তাই বেছে নিলেন। এটা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি আমাদের দেশের মঞ্চনাটকের উন্নয়নের জন্য সবসময়ই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ সর্বত্র যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাহলো সবসময় ন্যায় ও সত্যের পথে সোচ্চার হয়ে কথা বলেছেন। এত অল্প সময়ে তার চলে যাওয়া একদমই মেনে নেয়া যায় না।
নিশাতের মতো মানুষ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাচ্ছি না
শিমূল ইউসুফ
নাট্য সংগঠক ও অভিনেত্রী
নিশাতের জন্ম যখন হয়, তখন আমি ওকে কোলে নিয়েছিলাম। আমাদের বন্ধনটা অনেক কালের, ওর জন্মলগ্ন থেকে আমার সঙ্গে ওর বন্ধন। নিশাতকে কখনো আমি নাট্যকর্মী হিসেবে দেখিনি, মানুষ হিসেবে দেখেছি। ও আমার কন্যা সমতুল্য ছিল। নিশাতকে নিয়ে আসলে এখন কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করছি না, ও চলে গেছে। নিশাতের মতো মানুষ দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাচ্ছি না, কবে পাব তাও জানি না। আমি বলেছিলাম নিশাত আমি আগে চলে যাব, তারপর তোরা যাবি। কিন্তু ও সবসময় বলত, ঘরের মধ্যে কোন দিন মরে পড়ে থাকব শিমূল আপা, আপনারা জানবেনও না। তা-ই সত্যিই হলো। আমার ইস্কাটনের বাসায় নিশাত থাকত। ও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। কি করব এই শূন্য বাড়ি দিয়ে। নিশাত নেই, বাড়িটাও নিশ্চিত কাঁদছে।
‘নিশাত কখনো আপস করেনি’
মাসুম রেজা
নাট্যকার
ইশরাত নিশাতের মতো একজন বলিষ্ঠ নাট্যকর্মীর প্রস্থান আমাদের নাট্যজগতের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। কারণ নিশাত ছিলেন মনেপ্রাণে সর্বান্তরকরণে একজন থিয়েটারের মানুষ। থিয়েটারের যত অসংগতি তার চোখে পড়েছে, সেসবের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। নিশাত কখনো আপস করেননি। নিজের আদর্শ ও নীতির প্রতি স্থির থেকেছেন সবসময়। তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, মনে যা আসত, তা-ই সরাসরি বলে দিতেন, যা থিয়েটারে খুবই জরুরি।
নিশাতের সঙ্গে আমার ৩৪ বছরের বন্ধুত্ব এবং তা একই দলে একই সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার অসংখ্য নাটকের স্মৃতি, অসংখ্য জীবনের স্মৃতি। আমি খুবই অসহায়বোধ করছি। কারণ আমার নতুন নাটকের অভিনয়ের অংশটুকু নিশাত দেখছিলেন। কিন্তু তার এভাবে চলে যাওয়ায় আমার বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল। নিশাত যেভাবে ধরে ধরে প্রতিটি শব্দ সংলাপ নিয়ে কাজ করতেন, সে শূন্যতা কীভাবে পূরণ করব?
‘নিশাতের মতো নাট্য অন্তঃপ্রাণ, স্পষ্টবাদী, সাহসী মানুষ আর নেই’
ওয়াহিদা মল্লিক জলি
অভিনেত্রী ও শিক্ষক
পড়াশোনার কারণে একটা সময় ভারত ছিলাম। এ সময় মাঝে মধ্যে যখন ঢাকায় আসতাম, তখন নিশাত কেবলই আরণ্যক থেকে বের হয়ে দেশ নাটক করল। দেশ নাটকের শুরু থেকেই নিশাতদের সঙ্গে আমাদের পরিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সালাউদ্দিন লাভলু, মাসুম রেজা, নিশাতের সঙ্গে তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব ও হূদ্যতা। নিশাতের মতো এ রকম নাট্য অন্তঃপ্রাণ, স্পষ্টবাদী, সাহসী মানুষ আমাদের নাট্যাঙ্গনে দ্বিতীয়জন নেই। নিশাতের পুরো জীবনে থিয়েটার ছাড়া অন্য কিছু গুরুত্ব পায়নি।
‘আমার দেখা সবচেয়ে দৃঢ় কণ্ঠস্বর’
সামিনা লুত্ফা নিত্রা
শিক্ষক, সংগঠক
ইশরাত নিশাত আপা হলেন আমার ৩০ বছরে দেখা সবচেয়ে দৃঢ় কণ্ঠস্বর। তিনি যা কিছুকে ন্যায় বলে মনে করতেন, তা থেকে কখনো এক বিন্দু সরে দাঁড়াননি। তিনি যেটিকে অন্যায় মনে করেছেন, তা যে-ই করে থাকুক, তার বিরুদ্ধে খুব জোরের সঙ্গে স্পষ্ট করে সাহস নিয়ে বলে ফেলতেন। মহিলা সমিতির সিঁড়ি থেকে শুরু করে শিল্পকলার সিঁড়ি পর্যন্ত তার পথচলায় অভিনয় নাট্য নির্দেশনা করে গেছেন, এগুলো অনেকেই করে থাকেন। কিন্তু তিনি আরো যা যা করে গেছেন, সেসব কেউ করেননি।
নিশাত আপা মেন্টরিং করে গেছেন। বিশেষ করে আমরা যারা নারী নাট্যকর্মী, আমাদের মনেই হচ্ছে, আমাদের মাথার ওপর থেকে বিশাল ছায়া সরে গেছে। তিনি নিজেই ছিলেন একটা স্টেটমেন্ট। স্টেটমেন্ট এই অর্থে বললাম, তার ওই দাঁড়িয়ে থাকা, ওই কথাবার্তা, এমনকি তার ‘সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে’ থাকার ওই মুখটি আসলে আমাদের অনেক কিছু স্বপ্ন দেখতে বা ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে। থিয়েটারের অন্য অনেককে সবাই চেনে। কেউ কেউ বিখ্যাত তারকা। বিপরীতে নিশাত আপাকে থিয়েটারের বাইরের মানুষজন খুব বেশি চেনে না। আমরা যারা চিনি, তারা জানি, তার মূল্যটা কোথায়।