কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে ফুলের আবাদ বেড়েছে। যশোর জেলার সদর, ঝিকরগাছা, শার্শা, চৌগাছা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, ঢাকার সাভার, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদীসহ বেশকিছু জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের আবাদ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন দেশের কৃষকের মাঝেও প্রবাহিত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে টাটা ও বিড়লার মতো বড় মাপের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করছেন। তবে বাংলাদেশে এখনো বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান না এলেও দেশের ক্ষুদ্র কৃষকরাই ফুলের বাণিজ্যিক চাষে মূল ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের বিভিন্ন দিবস ও উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ফুলের চাহিদা বাড়ছে। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ফুলের চাহিদা ব্যাপক। প্রতি বছর ফুলের চাহিদা বাড়ছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার মূল্যের ফুল বেচাকেনা হয়। যদিও ফুল রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। সম্প্রতি রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, অর্কিড, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডুলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ বেশকিছু ফুল রফতানি শুরু হয়েছে।
তবে রফতানি বাজারে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে গোলাপের। বিশেষ রঙ ও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশের গোলাপের চাহিদা বাড়ছে। তবে ফুলের নিচে কাণ্ডতে একটি নির্দিষ্টি পরিমাণ মাপ থাকতে হয়। সেই আকার বাংলাদেশের ফুলে পাওয়া যায় না। মূলত আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে দেশের বিজ্ঞানীরা ফুলের সেই আকার পেতে বিশেষ ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছেন। সেটি এখন সম্প্রসারণ করা হচ্ছে দেশের ফুলের বাজারে পরিচিত নাম যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এরই মধ্যে সফলতা পাওয়া গেছে। এখন সেটির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
স্থানীয় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গদখালী থেকে বিভিন্ন জাতের ফুল কেনেন ঢাকার ব্যবসায়ীরা। পরে তারা নিজ উদ্যোগে সেসব ফুল কয়েকটি দেশে পাঠান। তবে গোলাপের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুলের উচ্চতা। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে যেসব গোলাপের চাহিদা বেশি, সেগুলোর উচ্চতা ৩৮ সেন্টিমিটার। কিন্তু গদখালীতে চাষ হওয়া গোলাপের উচ্চতা ৩৬ সেন্টিমিটার। এ ২ সেন্টিমিটার উচ্চতা সংকট গদখালীর গোলাপকে রফতানি বাজারে পিছিয়ে রেখেছে। একই সঙ্গে গদখালীতে চাষ হওয়া গোলাপের রঙ খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার রফতানি বাজার ধরতে এটিও বড় একটি সমস্যা।
গদখালীর গোলাপ রফতানির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি একসময় গদখালী ফুলচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন। আব্দুর রহিম বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে প্রাথমিকভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চার হাজার পিস গোলাপ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু পুরো চালান ফেরত এসেছে। আমাদের বলা হয়েছে, গদখালীর গোলাপের উচ্চতা দুই সেন্টিমিটার কম। রঙ অনেকটাই ক্ষয়ে যাওয়া। এসব কারণে অস্ট্রেলিয়ার বাজারে এ ফুলের চাহিদা নেই। একই সমস্যার কথা জানিয়েছেন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরাও। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে রফতানি করতে হলে গদখালীতে ৩৮ সেন্টিমিটার উচ্চতার গোলাপ চাষ করতে হবে। বাড়তি যত্নের মাধ্যমে ফুলের রঙ ও মান ধরে রাখতে হবে। তা না হলে রফতানি বাজারে গদখালীর গোলাপ জায়গা করে নিতে পারবে না।
গোলাপের উচ্চতা সংকট ও মানহীনতার প্রধান কারণ প্রচলিত চাষ পদ্ধতি। আমাদের দেশে মূলত সাধারণ জমি কিংবা ক্ষেতে ফুল চাষ করা হয়। নেয়া হয় না বাড়তি যত্ন। এমনকি রফতানি বাজারের কথা মাথায় রেখে বিশেষভাবে ফুলের চাষ পদ্ধতি প্রণয়ন কিংবা বাড়তি যত্নের বিষয়টি আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। এ কারণে ফুলের রফতানিযোগ্য মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া থেকে চালান ফেরত আসার পর গদখালীর ফুলচাষীরা এ চ্যালেঞ্জের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি বাজার ধরতে গদখালীতে গোলাপ চাষে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। এখন স্থানীয় অনেক ফুলচাষী পলি হাউজ পদ্ধতিতে গোলাপ চাষে ঝুঁকেছেন। এ পদ্ধতিতে গোলাপের উচ্চতা রফতানিযোগ্য মাপে রাখা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে আলো, বাতাস, তাপমাত্রা, পানিপ্রাপ্তি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে গোলাপের রঙ ও মান ধরে রাখাও সম্ভব হবে। ফলে মানসম্পন্ন গোলাপ ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার বাজারে রফতানি করা যাবে।
স্থানীয় পানিসারা গ্রামের ফুলচাষী শাহজাহান সরদার ২৬ শতাংশ জমিতে পলি হাউজ পদ্ধতিতে ফুল চাষ করছেন। তিনি জানালেন, এটা কঠিন কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। বরং চাষের শুরুতে ক্ষেতের ওপর পাতলা পলিথিনের শেড বা ছাউনি দিয়ে এ পদ্ধতিতে ফুল চাষ করতে হয়। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পলিথিনের হাউজের মতো লাগে বলে একে পলি হাউজ পদ্ধতি বলে। স্থানীয়রা অনেকে একে পলিশেড বলে থাকে। ছাউনি থাকার কারণে ফুলের ওপর সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না। ফলে ফুলের রঙ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করা যায়। ছাউনি বাইরের অতিরিক্ত আলো, বাতাস, পানি থেকে ফুলকে রক্ষা করে। ছাউনির ভেতর নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাপমাত্রা। এর ফলে উৎপাদিত ফুল মানসম্পন্ন হয়। সহজে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বাড়তি যত্নের জন্য প্রত্যেকটি ফুলে আলাদা করে ক্যাপ লাগাতে হয়। এতে ফুলের পরিপক্ব হওয়ার সময় বিলম্বিত হয়। উচ্চতা বাড়ে।
শাহজাহান সরদার বলেন, প্রচলিত চাষ পদ্ধতিতে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির কারণে গোলাপ ও জারবেরা ফুল ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে লোকসানে পড়েন ফুলচাষীরা। কিন্তু পলি হাউজে চাষাবাদের কারণে বৃষ্টির পানি সরাসরি ফুলের ওপর পড়তে পারে না। ছাউনিতে বাধা পায়। এতে ফুল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। কমে এসেছে লোকসানের ঝুঁকিও।
স্থানীয় নীলকণ্ঠনগর গ্রামের ফুলচাষী কামারুল ইসলাম ৫০ শতাংশ জমিতে পলি হাউজ পদ্ধতিতে গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, নতুন এ পদ্ধতি ফুলের রঙ ও মান নিশ্চিত করছে। রফতানিযোগ্য উচ্চতায় গোলাপ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রফতানিও করা যাবে এসব গোলাপ।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানালেন, সারা দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা ফুলকে কেন্দ্র করে। ২০ হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার ফুলচাষী রয়েছে। বছরজুড়ে টুকটাক বিক্রি হলেও মূলত ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি দিবস সামনে রেখে জমে ওঠে দেশের ফুলের বাজার। এ সময়টায় হাসি ফোটে গদখালীর ফুলচাষীদের মুখে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশের বাজারে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, দেশের বাইরে গদখালীর গোলাপ রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছে। পলি হাউজে মানসম্পন্ন ও সঠিক উচ্চতার ফুল চাষ শুরু হয়েছে। সফলতাও মিলছে। আশা করছি, শিগগিরই ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে পৌঁছে যাবে গদখালীর মানসম্পন্ন গোলাপ। এতে এখানকার ফুলচাষীদের আয় বাড়বে। তাদের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হবে।
এদিকে গদখালীর ফুলচাষীদের সুবিধার্থে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি-সেচ) যশোর অফিস জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিপইরিগেশন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় গদখালীতে আটটি সোলার পাম্প, আটটি গভীর সেচ পাম্প এবং ছয়টি পলি হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ১৫০ জন কৃষকের ৩৬০ বিঘা জমি ফুল চাষের আওতায় আনা হয়েছে।
বিএডিসি (সেচ) যশোর অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী ও কর্মসূচি পরিচালক মো. মাহবুব আলম বলেন, ডিপইরিগেশন একটি আধুনিক সেচ পদ্ধতি। এতে ডার্গওয়ালের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়। সেই পানি বছরজুড়ে ফুলচাষীরা ব্যবহার করতে পারেন। আগে এক বিঘা জমিতে দুজন শ্রমিকের পানি দিতে সময় লাগত ৩ ঘণ্টা। শ্রমিকরা ক্ষেতে খেয়াল-খুশিমতো পানি দেয়ার কারণে ফুল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকত। এখন এ পদ্ধতিতে মাত্র ১০ মিনিটে শ্রমিক ছাড়াই ফুলের ক্ষেতে প্রয়োজনীয় পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
যশোর এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গদখালীতে ফুলের বড় একটি বাজার নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে এ বাজারে ফুল সংরক্ষণের জন্য কুলিং সিস্টেম বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের দাবি, নতুন বাজারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা গেলে ফুল সংরক্ষণ করা যাবে। গদখালীর ফুল বিদেশে রফতানি করা সহজ হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যশোরে ৬৩৬ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে আঞ্চলিক কৃষি অফিস। এ সময় উৎপাদন হয়েছে ৫৮ কোটি ৮৩ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৫ পিস। এর মধ্যে গোলাপ ফুল উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৬ পিস।