সিপিবির সমাবেশে হামলা: ১০ জনের ফাঁসির রায়

আদালত প্রতিবেদক

রাজধানীর পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মামলার অপর দুই আসামি মো. মশিউর রহমান ও রফিকুল ইসলাম মিরাজকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।

আজ সোমবার ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রবিউল আলম এ রায় ঘোষণা করেনে।

এদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে ইসলামের শত্রু এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিব্রত এবং উৎখাত করার জন্য ওই বোমা হামলা চালানো হয় বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন বিচারক।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি এই বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। যে ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়। গুরুত্বর আহত হয় আরও ২৩ জন। ওই হামলার একই দিনেই ১৯ বছর পর এ রায় ঘোষণা করলেন আদালত।

এদিকে রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। দীর্ঘদিন পর হলেও সুন্দর একটি রায় আমরা পেয়েছি। আশা করি এ রায়ে নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা সন্তুষ্ট হবে।

তবে দুইজন খালাস পাওয়ার বিষয়ে মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষে পরিচালনাকারী ওই আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মাদ সালাহউদ্দিন হাওলাদার বলেন, খালাসপ্রাপ্ত দুই আসামি মূলত সিপিবিরই কর্মী ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণে কিছু না পাওয়া যাওয়ায় তাদের খালাস দিয়েছেন আদালত।

রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, মুফতি মাঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নুর ইসলাম। 

মামলাটিতে মুফতি আব্দুল হান্নান প্রধান আসামি ছিলেন। কিন্তু অন্য মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাকে ওই বছর ১৩ জুন অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত। 

অন্যদিকে দণ্ডিতদের মধ্যে শওকত ওসমান, সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান সুমন ও মঈন উদ্দিন কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তাদের আদালতে হাজির করা হয়। রায় ঘোষণার পর সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। উক্ত দণ্ডিত আসামিরা সবাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি এবং ওই মামলায় তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। 

এদিকে রায়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক হামলার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘আসামিরা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বাংলাদেশ (হুজি) এর সদস্য। তাদের ধারণা বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়, ইসলাম ধর্মের শত্রু এবং আল্লাহ খোদা মানে না। সেকারণে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আসামিরা এই বোমা হামলা ঘটিয়েছে। এ ছাড়াও তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং বিব্রত করার জন্য এই বোমা হামলা ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’

রায়ের পর্যবেক্ষণে ইসলাম ধর্ম যে জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না এ বিষয়ে বিচারক পবিত্র কোরআনের সূরা ‘মায়িদাহ’ এর ৩২ নম্বর আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম শান্তি ও সত্যের ধর্ম। মহান আল্লাহ কোন জঙ্গি সংগঠনকে বা কোন দলকে ধর্মের নামে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার কোন অধিকার প্রদান করে নাই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা ‘মায়িদাহ’ এর ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ‘যে কেউ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে, অন্য কোন প্রাণের বিনিময় ব্যতীত কিংবা পৃথীবিতে কোন ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করলো।’ 

সর্বোচ্চ শান্তি মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া ১০ আসামি প্রত্যেকেই একাধিক হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা আসামি। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে তারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নারায়নগঞ্জ জেলার নেতা শামীম ওসমান এমপির অফিসে বোমা হামলা ও রমনা বটমূলের বোমা হামলা মামলারও তারা আসামি। এমনকি আসামিরা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। আসামিদের প্রতিটি বোমা হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ মারা গেছে। মামলার আসামিদের মধ্যে আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ী হরকাতুল জিহাদের হেডকোয়াটার ছিল। তারা পল্টন ময়দানে কমিউনিস্ট পার্টির মহাসমাবেশে বোমা হামলার মাধ্যমেও ৫ জন নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হত্যা করেন। পাশের আরও বোমা হামলায় আরও ৩ জনকে হত্যা করা হয়। আসামিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে কারণে এই দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখার জন্য হরকাতুল জিহাদের এই জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত মর্মে আদালত মনে করে।

সেদিন বোমা হামলায় যারা নিহত হয়, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মণ্ডল, খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আব্দুল মজিদ, ঢাকার ডেমরা থানার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের মুক্তার হোসেন, খুলনার বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রদাস, ফুটপাতের হকার, মোবারক হোসেন, বাদল ও সবুর।

ওই ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

মামলাটিতে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আসামিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে তদন্ত শেষে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর তদন্ত থেমে যায়।

এরপর ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের আগস্টে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা হয়। পরবর্তীতে ওইসব ঘটনায় মামলায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে এ মামলায় জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ আসে। এরপরই ২০০৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর পুলিশ মামলটি পুনঃতদন্তের আবেদন করেন। একই বছর ২৯ ডিসেম্বর আদালত পুনঃতদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন।

পুনঃতদন্তে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে ১৩ আসামির বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর মৃনাল কান্তি সাহা। একই সঙ্গে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩০ জনকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। পরের বছর ২১ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় আদালত মামলার ১০৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, একই ঘটনায় একই আসামিদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি একই আদালতে বর্তমানে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন