গালফ নিউজকে প্রধানমন্ত্রী

সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়

বণিক বার্তা ডেস্ক

বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নির্যাতিত অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানে ভারতে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রণয়ন করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাজধানী আবুধাবিতে গালফ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ভারত এটি (সিএএ) কেন করল আমরা বুঝতে পারছি না।

শেখ হাসিনা বলেন, ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনা যেমন ঘটেনি, তেমনি ভারত থেকে কোনো দেশান্তরিত ফের বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রমাণও নেই। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে দেশটির নাগরিকরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। 

গত মাসে সিএএ কার্যকরের পাশাপাশি দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকরের ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। এর পরই ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র আন্দোলন সহিংসতা। শেখ হাসিনা বলেন, এটি পুরোই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ বরাবরই সিএএ এনসিআরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করছে। ভারতের সরকারও এনআরসি যে একান্তই তাদের দেশের ব্যাপার তা বারবার নিশ্চিত করেছে। গত অক্টোবরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আমার সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আমাকে একই কথা জানান। বাংলাদেশ ভারতের সুসম্পর্ক বর্তমানে সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে। উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে বহু-বিস্তৃত পারস্পরিক সহযোগিতা।

ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক আছে বললেও মিয়ানমার নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ, মিয়ানমার থেকে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা, যারা বর্তমানে অবস্থান করছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার উত্পত্তি হয়েছে মিয়ানমারে। ফলে সমস্যার সমাধানও নিহিত রয়েছে মিয়ানমারেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে নিরাপদ সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার এখন পর্যন্ত যথার্থ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরই মধ্যে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। একজন রোহিঙ্গাও বাংলাদেশ থেকে ফেরত যেতে চাইছে না। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শেখ হাসিনার মতে, বাংলাদেশ ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকাল ধরে বহনে সক্ষম নয়। রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান না হলে দেশের ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে। অবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলকে করণীয় নিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ আরো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে পরিবেশবাদীদের। যদিও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে না বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের দশমিক শতাংশের উৎস কয়লা। তবে ভবিষ্যতে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশই হবে কয়লাভিত্তিক। তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ খুবই কম। উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। আর এজন্য যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হবে, তা যৌক্তিক বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত। তাছাড়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাই-প্রডাক্ট হিসেবে যে ফ্লাই অ্যাশ উত্পন্ন হবে, তা দেশজ সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা হবে।

২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় প্লাবনে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ উপকূলের কোটি ২০ লাখ মানুষ। এছাড়া পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র যমুনার মতো প্রধান প্রধান নদ-নদীতে ভাঙনও বাংলাদেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ব্যাপক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ২০১৬ সালে প্রথম ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ।

বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২২ বছর আগে দিনাজপুর জেলায় প্রথম কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে এখন পর্যন্ত তেমন পরিবেশগত বিপর্যয় হয়েছে বলে আমরা দেখিনি। আমি নিজে সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি।

অতীতে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক। এক দশক আগেও বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশের উৎস ছিল গ্যাস। কিন্তু দেশজ গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অবস্থায় বিকল্প হিসেবে কয়লা, তরল জ্বালানি পরমাণু শক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ধারাবাহিক উন্নয়ন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে থাকা জনগোষ্ঠীর বিদ্যুৎ ক্রয়ের সক্ষমতা আরো বাড়ছে। বিশেষ করে মোবাইল, কম্পিউটার ডিজিটাল ক্লাসরুমের জন্য দিন দিন বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা।

তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বায়োগ্যাস প্লান্টের পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে নেপাল, ভারত ভুটানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এছাড়া বর্তমানে চলছে দশমিক গিগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ। বেশ কয়েক বছর আগেই খুব দ্রুত স্থাপন করা হয় সৌরবিদ্যুৎ। দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত স্থাপন করা হয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ সোলার প্যানেল। বর্তমানে খাত বিভিন্ন এলাকায় মূল গ্রিডের সরবরাহ ছাড়াই বিদ্যুতের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি উপকূলীয় এলাকা, হোটেল রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। যদিও এর আগে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত মাত্রায় কার্যকর করা হয়নি।

বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পলিথিনের শপিংব্যাগ ব্যবহার বন্ধে পুরোপুরি সফলতা আসেনি সত্যি। এর মূলে রয়েছে পলিথিনের বিকল্প হতে পারে এমন স্বল্প খরচের ভালো উপাদানের অপ্রাপ্যতা। তাছাড়া পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে যে কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ সমস্যাও নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের অন্যতম অন্তরায়। তবে বর্তমানে ভুট্টা, কাসাভা শস্যের অবশিষ্টাংশ থেকে তৈরি পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) ব্যাগের মতো তুলনামূলক ভালো বিকল্প আমাদের হাতে আছে। তাছাড়া আমাদের এক বিজ্ঞানী পাটের সেলুলোজ দিয়ে পচনশীল ব্যাগ উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশে পাটও উৎপাদন হয় প্রচুর। আমি ব্যাগের নাম দিয়েছি সোনালি ব্যাগ একই সঙ্গে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি, যাতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাগ উৎপাদন সুলভ মূল্যে প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন