এক জমিতে মিশ্র ফসল

সিরাজগঞ্জে ২০ বছরে আবাদ বেড়ে তিন গুণ

অশোক ব্যানার্জী সিরাজগঞ্জ

সময়ের প্রয়োজনে ফসল আবাদের বৈচিত্র্য ও নিবিড়তা বাড়িয়েছেন সিরাজগঞ্জের কৃষকরা। একই জমিতে একই সময় একাধিক ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন তারা। এজন্য প্রত্যেক বছরই জেলায় মিশ্র ফসল আবাদে জমির পরিমাণ বাড়ছে। ২০০০ সাল থেকে চলতি মৌসুম (২০১৯-২০) পর্যন্ত জেলায় মিশ্র ফসলের আবাদ বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে।

মরিচের সঙ্গে ফুলকপি কিংবা বাঁধাকপি, বেগুনের সঙ্গে মরিচ, আলুর সঙ্গে মরিচ, মুলা, পালংশাক, ধনিয়া পাতাসহ নানা জাতের শাকসবজি একই জমিতে চাষ করছেন জেলার অধিকাংশ কৃষক। বিশেষ করে যেসব কৃষকের আবাদি জমি কম, তারাই এ পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করছেন।

কৃষকদের দাবি, জমিতে এক ফসল আবাদ করে লোকসানের ঝুঁকি থাকে। এজন্য জমিতে আবাদকৃত একটি ফসলের দাম বাজারে কম থাকলে অন্যটি দিয়ে তা পুষিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমি ১ লাখ ৮২ হাজার ২০০ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি জমি ১৭ হাজার ১০০ হেক্টর, দুই ফসলি ১ লাখ ৩০০ ও তিন ফসলি জমি রয়েছে ৬৪ হাজার ৪৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে অধিক ফসল আবাদ হচ্ছে এমন জমির পরিমাণ ৩২৫ হেক্টর। ২০০০ সালের দিকে সিরাজগঞ্জে মিশ্র পদ্ধতিতে ফসল আবাদ শুরু হয়। বিশেষ করে ধান কাটার পর রবি মৌসুমে একই জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ শুরু করেন কৃষকরা। ওই বছর জেলার ২২ থেকে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে মিশ্র ফসল আবাদ করা হয়। ২০১৯-২০ মৌসুমে এ জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার হেক্টরে। আগামী মৌসুমে এ পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ।

সদর উপজেলার বেজগাতী গ্রামের রমজান শেখ বলেন, ২৫ শতক জমিতে বেগুনের পাশাপাশি মরিচের চাষ করেছি। একই জমিতে দুই ধরনের সবজি চাষ করলেও ফলনে কোনো প্রভাব পড়েনি। বেগুন আর মরিচ দুটোর ফলনই ভালো হয়েছে।

তিনি বলেন, একটি ফসলে লাভ না হলেও আরেকটি দিয়ে লোকসান পুষিয়ে নেয়া যাবেএ চিন্তা থেকে মিশ্র ফসল আবাদ শুরু করেছি।

রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুড়কা গ্রামের কৃষক মুসা শেখ  বলেন, আমাদের জমি কম, তাই অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়ার জন্যই একই জমিতে একাধিক ফসল আবাদ করছি।

তিনি বলেন, অন্য সবজির তুলনায় বেগুন চাষ লাভজনক। প্রতি বিঘায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে ৪০-৫০ মণ বেগুন উৎপাদন হয়। বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। বেগুনের সঙ্গে মরিচ চাষ করলে বাড়তি কিছু আয় হয়। তাই বেগুন গাছের ফাঁকে ফাঁকে মরিচের আবাদ করেছি। প্রতি বিঘায় ছয়-সাত মণ কাঁচামরিচ উৎপাদন হবে বলে আশা করছি, যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা।

রায়গঞ্জ উপজেলার জয়েনপুর গ্রামের ফরিদুল ইসলাম বলেন, আমার ১৫ বিঘা জমির মধ্যে পাঁচ বিঘা জমিতেই সবজি চাষ করেছি। প্রথম মৌসুমে ফুলকপি চাষ করেছিলাম। ফলন তেমন ভালো না হলেও মৌসুমের শুরুতে বিক্রি করায় লাভ হয়েছে। এবার আবারো ফুলকপি ও বাঁধাকপি একসঙ্গে আবাদ করেছি। এছাড়া অন্যান্য জমিতে বেগুন, মরিচ, আলু, লাউ, মিষ্টিকুমড়া মিশ্রভাবে আবাদ করেছি।

একই উপজেলার হাসনপুর গ্রামের আলী হোসেন বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে এক বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল বেগুন চাষ করেছিলাম। মৌসুমের শুরুতেই বেগুন বিক্রি করতে পেরেছি। উচ্চফলনশীল বেগুন চাষে লাভ হয়েছে। একই জমিতে মরিচের চাষ করেছি। তাও বিক্রয়যোগ্য হতে শুরু করেছে।

তিনি বলেন, আগে কৃষকরা জমিতে এক ফসল আবাদে অভ্যস্ত ছিলেন। বর্তমানে সেটা আর নেই। সময়ের প্রয়োজনেই কৃষক একই জমিতে বাড়তি আয়ের পথ বের করেছেন।

এদিকে সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদিত সবজির প্রকৃত দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের। তাদের দাবি, বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি বেগুন ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও চাষীদের কাছ থেকে তা ১৫-২০ টাকায় কিনছেন পাইকাররা। একইভাবে ফুলকপি বিক্রি করতে হচ্ছে ২০-২৫ টাকা কেজিতে, যার বাজারমূল্য ৪০-৫০ টাকা।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) মো. হাবিবুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সত্তরের দশকে সিরাজগঞ্জে প্রতি জমিতেই একটি ফসল আবাদ হতো। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই এখন কৃষক মিশ্র চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। বিশেষ করে শীতকালীন সবজির মৌসুমে অধিকাংশ কৃষক একই জমিতে একাধিক ফসল চাষ করছেন। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষকও লাভবান হচ্ছেন। ২০ বছরের ব্যবধানে মিশ্র ফসল আবাদ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। একই জমিতে একসঙ্গে একাধিক ফসল চাষে কৃষক যেমন লাভবান হন, তেমনি শস্যাবর্তনের ফলে জমির উর্বরাশক্তিও বাড়ে। আমরা মিশ্র ফসল আবাদে কৃষকদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। আগামী বছর মিশ্র ফসল আবাদ আরো বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন