গত বেশ কয়েক মাসে ব্যাংকঋণের ওপর সুদহার বেঁধে দেয়ার (ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপ) সুফলের বিষয়ে নতুন করে একটি বিতর্ক উদয় হয়েছে। এর উদ্দেশ্য তহবিল ব্যয় হ্রাস এবং ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি বাড়াতে সাহায্য করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা। উদ্যোগটি সদিচ্ছাপ্রসূত হলেও সুদহার বেঁধে দেয়ার ফল সরাসরি বিপরীত হতে পারে। ব্যাংকিং খাতের নাজুকতা বাড়িয়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে এতে বরং বিশেষ করে ব্যক্তি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর (এসএমই) জন্য ঋণপ্রাপ্তির সংকট তৈরি হবে। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এই ‘মুভি’ বিশ্বের অনেক জায়গায় চলতে দেখেছেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিপর্যয়কর না হলেও যেকোনো অর্থনীতিতে সুদহার বেঁধে দেয়ার ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে।
আফ্রিকায় কেনিয়ার পার্লামেন্ট ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণের ওপর ৪ শতাংশের (যা নীতিহারের সামান্য উপরে) সুদহার বেঁধে দিয়ে একটি বিল পাস করেছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই বেঁধে দেয়া সুদহার বাতিল হয়। কারণ এটি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে আলোচ্য পদক্ষেপ দেশটির অর্থনীতি ও মানুষের কল্যাণে প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এক মেমোরেন্ডামে পার্লামেন্টকে এটি বাতিলের আহ্বান জানানো হয়। ওই মেমোরেন্ডামে বলা হয়েছে, ‘এটি
দৃশ্যমান যে সুদহার বেঁধে দেয়ার পদক্ষেপ বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলেছে, যা তাত্পর্যপূর্ণ এবং এটি আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি করছে। বিশেষত অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো (এমএসএমই) উল্লিখিত পদক্ষেপের সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার।’
এ নিবন্ধে ব্যবহূত লেখচিত্র-১ দেখা যায়, কেনিয়ায় ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ প্রদান অলাভজনক হয়েছে এবং বেঁধে দেয়া সুদহার বাস্তবায়ন হওয়ার অব্যবহিত পরই প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি (রিয়েল ক্রেডিট গ্রোথ) দ্বিগুণ থেকে প্রায় ঋণাত্মকে চলে গেছে। বিশেষ করে ব্যক্তি উদ্যোক্তা, অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও এসএমইকে ঋণ দেয়া ছোট ব্যাংকগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেমোরেন্ডামে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গবেষণা
নির্দেশ করে যে ঋণদান কার্যক্রম ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ১২ মাস শেষে প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। ছোট ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সুদহারে অসামঞ্জস্যহীনভাবে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কারণ তাদের ব্যবসায়িক মডেল উচ্চঝুঁকি বা হাইয়ার রিটার্ন বরোয়ারদের ওপর অধিক নির্ভরশীল। মেমোরেন্ডামে আরো বলা হয়েছে, ‘কুসীদজীবীদের
লালনপালন বা বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত ঋণদাতারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ব্যক্তির অর্থায়ন ঘাটতির সুযোগ নিয়েছে।’ এর প্রত্যক্ষ ফল হলো, জিডিপির অনুপাতে কেনিয়ায় ব্যক্তিখাতের ঋণ আগের ৩৪ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
স্বাভাবিক কারণেই ঋণপ্রাপ্তির ঘাটতিতে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ভুগেছে। ফলে ২০১৭ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি কমেছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে কমেছিল শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। সরকারের কর রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে। অধিকন্তু, কেনিয়ার ব্যাংকিং ব্যবস্থার খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। খেলাপি ঋণের প্লাবন ঘটেছিল, কারণ ঋণপ্রদানকারীর চলতি মূলধন ও মূলধন ব্যয়ের চাহিদা ব্যাহত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের (যেমনটা বেঁধে দেয়া সুদহারে আশা করা হয়েছিল) পরিবর্তে এটি বিপুলসংখ্যক খেলাপি গ্রাহক সৃষ্টি করেছিল এবং প্রকৃত ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কষ্ট বাড়িয়েছিল।
কেনিয়া বিচ্ছিন্ন কোনো উদাহরণ নয়। বিশ্বব্যাংক বিশ্বজুড়ে সুদহার বেঁধে দেয়া নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সেখানে সিদ্ধান্ত টেনেছে যে সুদহার বেঁধে দেয়ার প্রায় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো, দামে স্বচ্ছতা কমানো, ঋণপ্রবাহ ঘাটতির সংকট তৈরি, ক্ষুদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণদাতার জন্য ঋণ অনুমোদনের হার হ্রাস, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমানো ও ব্যাংকের শাখা নিবিড়তা হ্রাস এবং সর্বোপরি ব্যাংকের মুনাফাযোগ্যতার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলা।
এদিকে আমানতের হার বেঁধে দেয়াও উল্লিখিত বিষয়গুলোর উন্নয়ন ঘটায় না। এটি বরং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত ৬ শতাংশ আমানতের হার এবং ৯ শতাংশ ঋণ-সুদহার বাস্তবায়নের মাধ্যমে অধিকাংশ ব্যাংক তাদের ঋণ ও পরিচালন ব্যয় খুব কমই পোষাতে পারবে। তাছাড়া এসএমই ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ে মনোযোগী ব্যাংকগুলোর অন্তর্নিহিতভাবেই ব্যয়ভিত্তি থাকে বেশি। কারণ তারা যতটা পারে, অবশ্যই নিজেদের গ্রাহকদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করে। অধিকন্তু, বাজার চাহিদার চেয়ে আমানতে কম সুদের হার প্রদান করা হলে আমানতকারীরা বিনিয়োগের বিকল্প রাস্তা খুঁজবেন। এটি আমানত প্রবৃদ্ধিতে অধোগতি ঘটাবে। আলোচ্য পদক্ষেপ এরই মধ্যে বিপর্যয়কর তারল্য সংকটের মুখোমুখি হওয়া ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ আরো বাড়াবে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশী ব্যাংকগুলো কেনিয়ার ব্যাংকগুলোর চেয়ে কম নগদপ্রবাহ (কুশন) নিয়ে উল্লিখিত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু করবে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ অনেক বেশি, তদুপরি ব্যাংকগুলোর মুনাফাযোগ্যতা কেনিয়ার বেঁধে দেয়া হার-পূর্ব (প্রি-রেট ক্যাপ) সময়ের তুলনায় অনেক কম। সুদহার বেঁধে দেয়ার আগে কেনিয়ায় সম্পদের ওপর রিটার্ন ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। কেনিয়ায় খেলাপি ঋণ ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশ। ব্যবস্থাগত-পদ্ধতিগত অভিঘাত (সিস্টেম শক) মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে এবং এ ধরনের অভিঘাত সামলানোয় বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা ও সামর্থ্যও খুবই কম। সুদহার বেঁধে দেয়ার আগে কেনিয়ার ব্যাংকগুলোর ১৯ শতাংশ মূলধনের (ক্যাপিটালাইজেশনের) বিপরীতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মূলধন এরই মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই ধরনের অভিঘাত ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং এভাবে অর্থনীতি ও মানুষের কল্যাণে বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলতে পারে।
উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি বাড়াতে আরো কিছু কার্যকর উপায় আছে। সঞ্চয়পত্রে আকর্ষণ হ্রাসের মাধ্যমে সরকার এরই মধ্যে সঠিক পথেই রয়েছে। এতে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে ব্যাংক আমানতে গ্রাহকরা ঝুঁকতে পারেন। বাজেট ঘাটতি এবং ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া কমানোও উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তির সমস্যা দূর করবে। একই সঙ্গে এটি সরকারি সিকিউরিটিজের চেয়ে বাণিজ্যিক ঋণে অধিক আমানত সরবরাহের সুযোগও দেবে। অনুরূপভাবে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকের মতো প্রধান শিল্প খাতগুলোয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে সরবরাহ দিক থেকে সরকার ভালো কাজ করছে। অন্য ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ঋণ কেলেঙ্কারি ও বড় ঋণগ্রহীতার খেলাপি ঋণ কমানো, যাতে উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের কাছে নগদ অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়। ঋণ বণ্টন ব্যয় হ্রাসকারী প্রযুক্তিগুলো উন্নয়নেও দীর্ঘমেয়াদে সাহায্য করবে।
গত দশকজুড়ে বিশ্বে বাংলাদেশের চমকপ্রদ ও আশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড নজির হয়ে আছে। এটি প্রশংসনীয় যে দেশটির ব্যবসায়িক জনগোষ্ঠী এ অর্জনে আত্মতুষ্ট নয় এবং তারা আরো অগ্রগতি নিশ্চিতে নানা পথ খুঁজছে। দুর্ভাগ্যক্রমে সুদহার বেঁধে দেয়া (রেট ক্যাপ) দেশটির প্রবৃদ্ধি ইঞ্জিনের প্রধান পরিচালনাকারী ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সাহায্যের পরিবর্তে তাদের উদ্যোগ-ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতার হাতিয়ার হবে বৈকি। এটি দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সর্বনাশা পরিণামের কারণ হতে পারে, যা গত দশকের বেশি সময় ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দৃষ্টান্তমূলক অভিজ্ঞতা হিসেবে আমরা দেখে এসেছি।
বেদি গু: নিউইয়র্কভিত্তিক দ্য রোহাটিন গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও প্রতিষ্ঠানটির বিয়ন্ড ব্রিক পাবলিক ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিসের পোর্টফোলিও ম্যানেজার
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির