সম্পৃক্ত পক্ষের সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির লেনদেনের পরিমাণ প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদ কিংবা রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশ বা তার বেশি হলে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হয়। ২০০৯ সালের জুনে এক প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয় বিএসইসি। কিন্তু তা মেনেই এ ধরনের লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে কিছু বহুজাতিক কোম্পানি। নির্দেশনা না মানা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারছে না বিএসইসি। কারণ তারা বাজারের অনেক বড় প্লেয়ার। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের অসহায়ত্বের সুযোগ কতটা রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বটে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিয়ম না মানার প্রবণতা নতুন নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিএসইসি দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বড় কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আবার কোম্পানিগুলো বিএসইসির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। এটি একটি দুষ্টচক্র। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে বিএসইসিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। অ্যাডহক ভিত্তিতে নির্দেশনা প্রদান না করে সার্বিক বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন প্রণয়ন করা জরুরি। পুঁঁজিবাজারের উন্নয়ন ছাড়া সামনে এগোনো যাবে না। মানুষের প্রয়োজনে আইনকানুন তৈরি হয়। আর সেই আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাজ, জাতি, প্রতিষ্ঠান, দেশ সুশৃঙ্খল হয়। সেই আইন প্রয়োগেই আমাদের যত দুর্বলতা বা অনীহা। তা না হলে এত সংস্কার করেও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না কেন? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
১৯৯৬ সালে ধসের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর অনেকেই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে বাজার ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ—সব ক্ষেত্রেই আমাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি একটা বড় কারণ; কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সেগুলো দূর করা যাবে। দীর্ঘ আড়াই দশকেও একটা কার্যকর বিধিভিত্তিক ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ২০১০ সালে আরো একবার বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোনোবারই বাজারের নেপথ্য কারিগরদের জবাবদিহি করতে হয়নি। বরং সরকার সাময়িক দাওয়াই হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য টাকার সরবরাহ বাড়ানোর যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে বাজার পরিচালনাকারীরা লাভবান হয়েছেন। ওয়াল স্ট্রিটে কারসাজির জন্য সেই বাজারের সবচেয়ে প্রভাবশালী কারবারি বার্নি ম্যাডোফকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে কারসাজির দায়ে কাউকেই কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একদিকে যেমন তালিকাভুক্তির সময় শেয়ার অফলোড করেছে কম পরিমাণে, তেমনিভাবে তালিকাভুক্তির পর থেকে আর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। তালিকাভুক্ত এসব কোম্পানির কোনোটিরই যৌক্তিক পরিমাণ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে নেই। এমনকি তালিকাভুক্ত হওয়া পরবর্তী সময়েও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বারবার তাগিদ দিলেও গত ২১ বছর কোম্পানিগুলো বাজারে তাদের মূলধন বাড়ায়নি। অন্যদিকে বড় অংকের ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়ার প্রবণতাকেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না অনেকেই। অধিকাংশ কোম্পানির যথেষ্ট পরিমাণে রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালের পর থেকে মূলধন বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা ও রিজার্ভের পরিমাণ দেখে এটা এখন পরিষ্কার যে এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় শুধু কর রেয়াতের সুযোগ নেয়ার জন্য। এমনকি এসব কোম্পানির নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রবণতার সঙ্গে মানি লন্ডারিং জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ এবং অনৈতিক ও অবৈধ কাজ বন্ধ, সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় বিএসইসি গঠন করা হয়। প্রতিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতো বিএসইসিও বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা জারি করে বাজার স্থিতিশীল রাখে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বিধি-নিষেধ লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, নির্দেশনা অমান্যের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলেও অধিকাংশ সময় কোম্পানি, বিশেষত বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমনকি নির্দেশনা অমান্য করলেও কোম্পানিকে জবাবদিহি করতে হয়নি অতীতে। এ কারণে নির্দেশনা উপেক্ষা বা বিধি-নিষেধ অমান্য করার প্রবণতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিস্তার লাভ করছে। শক্তিশালী শেয়ারবাজার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিএসইসিকে দলমত নির্বিশেষে বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে সর্বাগ্রে। নির্দেশনা উপেক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। এ বার্তা বাজারে দিতে হবে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। নইলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কোনো অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিএসইসির নির্দেশনা না মানার ঘটনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে তদারকি আরো জোরদার এবং প্রতিটি বিধি-নিষেধ ও নির্দেশনা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যেন মেনে চলে, তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যারা বিধি ভঙ্গ করবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।