শীতল হয়ে পড়ছে মানুষ, ৯৮.৬ ডিগ্রি আর স্বাভাবিক নয়!

বণিক বার্তা অনলাইন

মানুষের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধরা হয় ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর দুয়েক ডিগ্রি বেশি হলে জ্বর হয়েছে বলে ধরা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এ মানদণ্ড সেকেল হয়ে গেছে। মানুষ ক্রমেই শীতল হয়ে পড়ছে! এক শতাব্দীর ব্যবধানে মানুষের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা অন্তত এক ডিগ্রি কমেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব মেডিসিন’ নতুন গবেষণায় জানিয়েছে, ১৬০ বছর বা তার কিছু বেশি সময় আগে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যা ছিল তা আর বহাল নেই। দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে গেছে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি। ফলে জ্বর মাপার সময় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রাকে (৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) স্বাভাবিক ধরা হয়, তা আর স্বাভাবিক নয়। এটি এখন ৯৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে নারীদের দেহের তাপমাত্রা পুরুষের তুলনায় কম কমেছে।  নারীদের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখন ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-সাময়িকী ‘ইলাইফ’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে বলা হচ্ছে, মানবদেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা বলা হয় ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এ মাত্রা সম্ভবত ১৮৫১ সালে সঠিক ছিল, যখন জার্মান চিকিৎসক কার্ল রেইনহোল্ড অগাস্ট ভান্ডারলিক ২৫ হাজার রোগীর বগলের তাপমাত্রা নিয়ে নিরূপণ করেছিলেন। সময় বদলেছে, আমেরিকানদের দেহের গড় তাপমাত্রা অন্তত ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমেছে। 

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব মেডিসিন’ এর অধ্যাপক জুলি পারসোনেট জানান, তার টিম তিনটি বিশাল ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিয়েছে। ১ লাখ ৯০ হাজার লোকের মধ্য থেকে ৬ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি তাপমাত্রার হিসাব নেয়া হয়েছে। উপাত্তগুলোর কাল ১৮৬২ থেকে ২০১৭ সাল। প্রথম ডাটাবেজটি ১৮৬২ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত (গৃহযুদ্ধকালীন) ইউনিয়ন আর্মির সৈনিকদের। দ্বিতীয়টি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভের ডাটাবেজ, আর তৃতীয়টি ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে স্ট্যানফোর্ড ট্রানজিশনাল রিসার্চ ইনটিগ্রেটেড ডাটাবেজ এনভাইরনেমেন্ট জরিপ।

গবেষকরা দেখেছেন, সময়ের সঙ্গে গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমেছে। তাদের উপাত্ত বলছে, বর্তমানে মানুষের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ৯৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তারা দেখেছেন, ১৫০ বছরের মধ্যে প্রতি দশকে মানুষের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমেছে। এক্ষেত্রে পুরুষের কমেছে দশমিক ০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং নারীর কমেছে দশমিক ০২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।

এক দিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের শরীরের তাপমাত্রা কমছে। এর কারণ কী হতে পারে? এর ব্যাখ্যায় গবেষকরা বলছেন,  ১৬০ বছর আগে জার্মান চিকিৎসক ভান্ডারলিক যখন স্বাভাবিক তামপাত্রার হিসাবটা করেছিলেন তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৮ বছর। নানা রোগ, সংক্রমণ ও প্রদাহে মানুষের অকাল মৃত্যু হতো। শরীরকে যখন নানা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় তখন তাপমাত্রা বাড়ে। এ কারণেই বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে, আর তরুণদের গা প্রবীণদের তুলনায় বেশি গরম থাকে। এরকম হয় কারণ, তরুণরা বিভিন্ন রকমের প্রদাহে আক্রান্ত হয় বেশি। 

কিন্তু আধুনিককালে প্রদাহের নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে। ওষুধ সেবনের মাধ্যমে প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় ফলে তরুণদের শরীরের গড় তাপমাত্রাও আর সেভাবে বাড়ছে না। দেড় দু’শো বছর আগে এসব ওষুধ ছিল না। ফলে ওই সময় তরুণদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে বেশি ছিল।

আরেকটি বড় কারণ হলো মানুষের শারীরবৃত্তীয় ও বিপাক ক্রিয়া আগের চেয়ে বেশ কমেছে। এসব প্রক্রিয়ায় শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে। আগে মানুষ প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করতো। এ কারণে তাদের বিপাক ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার হারও ছিল বেশি। ফলে শরীরের স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রাও বেশি থাকতো। কিন্তু আধুনিককালে মানুষের কায়িকশ্রম অনেক কমে গেছে। আয়েশি জীবনযাপনের কারণে বিপাকক্রিয়াও কমে গেছে। ফলে মানুষ শীতল হয়ে যাচ্ছে।

৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটকে গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসেবে নেয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কারণ এটি একটি গড় হিসাব। ১৮৫১ সালে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা জানতে ২৫ হাজার রোগীর তাপমাত্রা রেকর্ড করেছিলেন জার্মান চিকিৎসক ভান্ডারলিক। গড় মানেই হলো ব্যক্তিভেদে তা সামান্য কম বেশি হতেই পারে। গড় হিসাবের বিষয়টি না জানা বা উপেক্ষা করার কারণেই ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটকে মানবদেহের নির্ভুল স্বাভাবিক তাপমাত্রা বলে ধরা নেয়া হয়। আর ওই সময় বগলের নিচে থার্মোমিটার রেখে তাপমাত্রা নেয়া হতো, এখন জিভের নিচে থার্মোমিটার রাখা হয়। তাছাড়া এই প্রায় দুশ বছরের মধ্যে দেহের তাপমাত্রা মাপার থার্মোমিটারের প্রযুক্তিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।

সূত্র: টাইম ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন