দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্যতম বহুজাতিক
কোম্পানি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। ৩১ মার্চ সমাপ্ত ২০১৯ হিসাব বছরে
সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান জেনসন অ্যান্ড নিকোলসন বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে প্যাকিং
কনটেইনার ক্রয় বাবদ ৫৪ কোটি টাকা লেনদেন করেছে কোম্পানিটি, যা তাদের আগের বছরের রাজস্ব আয়ের ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। সম্পৃক্ত পক্ষের সঙ্গে
লেনদেনের পরিমাণ কোম্পানির রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশ বা তার বেশি হলেই এ ধরনের লেনদেনের
বিষয়ে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হয়। যদিও এ লেনদেনের বিষয়ে কোনো অনুমোদন নেয়নি
বার্জার,
যা বিধিবহির্ভূত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুধু বার্জার নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ না করে সম্পৃক্ত পক্ষের সঙ্গে লেনদেন
করেছে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি
লিমিটেড
(বিএটিবিসি), হাইডেলবার্গ
সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড।
আইনবহির্ভূতভাবে সম্পৃক্ত পক্ষের সঙ্গে লেনদেনের
বিষয়ে জানতে চাইলে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের কোম্পানি সচিব আবু জাফর মো. সাদিক বণিক বার্তাকে বলেন, যদি কমিশন এ
বিষয়ে জানতে চায়, তাহলে আমরা ব্যাখ্যা দেব।
তবে সাবসিডিয়ারি কোম্পানিটির শতভাগ শেয়ার বার্জারের কাছে থাকায় এ ধরনের লেনদেনের
ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
রিলেটেড পার্টি বা সম্পৃক্ত পক্ষের সঙ্গে
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেনের বিষয়ে ২০০৯ সালের ১ জুন একটি
প্রজ্ঞাপন জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি এর কোনো পরিচালক কিংবা পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট
কোম্পানির সঙ্গে নিজের স্থায়ী সম্পদ কিংবা রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশ বা তার বেশি পরিমাণ
সম্পদ কেনাবেচার চুক্তি করতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়,
এমন কোনো প্রাইভেট কোম্পানি যার পরিচালক কিংবা সদস্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিটিরও
পরিচালক,
কিংবা এমন কোনো পাবলিক কোম্পানি, ম্যানেজিং এজেন্ট, ম্যানেজার বা পরিচালক যিনি
তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির যেকোনো পরিচালকের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করে থাকেন—এমন কারো সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের ১ শতাংশ বা তার
বেশি পরিমাণ সম্পদ কেনাবেচার চুক্তি করতে পারবে না তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি।
একইভাবে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানির রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশ
কিংবা তার বেশি পরিমাণ পণ্য ও উপকরণ সরবরাহ করা যাবে না। এক্ষেত্রে যে হিসাব বছরে
রিলেটেড পার্টির সঙ্গে লেনদেন করা হবে তার আগের হিসাব বছরের স্থায়ী সম্পদ ও রাজস্ব
আয়ের ভিত্তিতে ১ শতাংশ বা তার বেশি পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।
বিএসইসির প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো চুক্তি করার ৩০ মিনিটের মধ্যে চুক্তির ধরন ও পরিমাণ বিএসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ফ্যাক্স কিংবা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে পাঠাতে হবে।
পাশাপাশি দুটি বহুল প্রচারিত বাংলা ও ইংরেজি
সংবাদপত্রে তা প্রকাশ করার কথাও বলা হয়েছে।
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এ
নির্দেশনা পরিপালন করছে কিনা, তা যাচাই করে
দেখার জন্য গত বছরের মে মাসে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেয় বিএসইসি। এর
পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর রিলেটেড পার্টি
লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন পাঠায়। কমিশনের কাছে দুই স্টক
এক্সচেঞ্জের পাঠানো প্রতিবেদনে স্থানীয় বেশকিছু কোম্পানির পাশাপাশি সাত বহুজাতিক
কোম্পানির নাম উঠে আসে, যারা আইনবহির্ভূতভাবে
রিলেটেড পার্টির সঙ্গে লেনদেন করেছে।
কমিশনের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনের তথ্যমতে, তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট বিএটিবিসি ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরে
একই গ্রুপের কোম্পানি বিএটি (জিএলপি) লিমিটেডের কাছে ৭৮ কোটি টাকার তামাক রফতানি করেছে, যা কোম্পানিটির আগের হিসাব বছরের রাজস্ব আয়ের ১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ লেনদেনের
বিষয়ে কোম্পানির পর্ষদ কিংবা শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হয়নি।
বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আন্তর্জাতিক হিসাবমান অনুসরণ করেই আমরা রিলেটেড পার্টি লেনদেন করে থাকি। আর
এক্ষেত্রে কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বাইরে কোনো অর্থ পাঠানো হয়নি বরং বিদেশে তামাক
রফতানি করে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এসেছি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে স্টক
এক্সচেঞ্জ কিংবা বিএসইসির পক্ষ থেকে কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। যদি তারা আমাদের
কাছে জানতে চায়, তখন আমরা ব্যাখ্যা দেব।
সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ ৩১
ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরে সম্পৃক্ত কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট এশিয়া
লিমিটেডকে টেকনিক্যাল সার্ভিস ফি বাবদ ২৯ কোটি টাকা দিয়েছে, যা কোম্পানিটির আগের হিসাব বছরের রাজস্ব আয়ের ৩ শতাংশ। এ লেনদেনের বিষয়েও
কোম্পানির পর্ষদ কিংবা শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হয়নি।
এফএমসিজি খাতের বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো
বাংলাদেশ ৩১ মার্চ সমাপ্ত ২০১৯ হিসাব বছরে এর মূল কোম্পানি ভারতের ম্যারিকো
লিমিটেডের সঙ্গে ২৬ কোটি টাকার পণ্য কেনার বিপরীতে ৪৭ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছে, যা কোম্পানিটির আগের বছরের রাজস্ব আয়ের ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক বহুজাতিক কোম্পানি
আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি
আরএকে পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে ৩৯ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে, যা কোম্পানির আগের হিসাব বছরের রাজস্ব আয়ের ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে আরএকে সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ
শহীদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, কমিশনের
নির্দেশনা জারির আরো আগেই আমাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিটি গঠন করা হয়। মূলত আরএকে
সিরামিকসকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্যই সাবসিডিয়ারি কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এর ফলে আমাদের প্রয়োজনীয় বিদু্যুৎ আমরা সাবসিডিয়ারির কাছ থেকে নেব এটাই স্বাভাবিক।
এ কারণে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। তাছাড়া সাবসিডিয়ারিটির শতভাগ শেয়ারের
মালিকানা আরএকে সিরামিকসের। ফলে এখানে অন্য কোথাও অর্থ চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে
কমিশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়নি। যদি এ
বিষয়ে কমিশন আমাদের কাছে কোনো কিছু জানতে চায় তখন আমরা তাদের ব্যাখ্যা দেব।
এফএমসিজি খাতের আরেক বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট
বেনকিজার বাংলাদেশ ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরে এর মূল কোম্পানি
যুক্তরাজ্যের রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান ওভারসিজ লিমিটেডকে টেকনিক্যাল সার্ভিস ফি
বাবদ ১৯ কোটি টাকা দিয়েছে, যা কোম্পানির আগের হিসাব
বছরের রাজস্ব আয়ের ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব
মোহাম্মদ নাজমুল আরেফিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমে কোনো ধরনের মন্তব্য
করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কমিশন তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু জানতে চায়নি।
সিঙ্গার বাংলাদেশ ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব
বছরে এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রিটেইলস হোল্ডিং এশিয়া বিভিকে রয়্যালটি বাবদ ১৬ কোটি
টাকা পরিশোধ করেছে, যা কোম্পানির আগের হিসাব
বছরের রাজস্ব আয়ের ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
জানতে চাইলে সিঙ্গার বাংলাদেশের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) ও কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ
সানাউল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, এজিএমে
শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে বার্ষিক প্রতিবেদন, পরিচালকদের প্রতিবেদন এবং নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করাতে হয়। আর
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে রিলেটেড পার্টি লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য দেয়া থাকে।
এর মানে হচ্ছে শেয়ারহোল্ডাররা যখন আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করছেন তখন এর মধ্যে
থাকা সবকিছুই অনুমোদন করছেন। ফলে এখানে আলাদা করে রিলেটেড পার্টি লেনদেনের
ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। এ বিষয়ে স্টক
এক্সচেঞ্জ কিংবা বিএসইসির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয়নি বলে
জানান তিনি।