কালি-কলমের বুননে ‘সময়ের গল্প’

রুবেল পারভেজ

জীবনভর মানুষ আসলে কী সঞ্চয় করে? এমন প্রশ্নের কিনারা খোঁজা নিয়ে হয়তো অজস্র অ্যাখ্যান রচিত হয়ে গেছে এ ভূমণ্ডলে। প্রশ্নটির নিশ্চিত উত্তরের দেখা না মিললেও এতটুকু অনুভব করা যায়, শুরু থেকে জীবনের শেষাবধি মানুষ অজস্র গল্পকে আলিঙ্গন করে তার পথচলায়। অর্থাৎ ব্যক্তির সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর আজ যা যা ঘটছে, তার সবই কাল গল্প হয়ে জমাট বাঁধে মস্তিষ্কে। বলা চলে, মানুষ তার জীবনজুড়ে শুধু গল্পের বুননই করে যায়, কারণে-অকারণে-প্রয়োজনে। আর এ গল্প বুননের ক্যানভাস হিসেবেসময়ই উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত মানুষের অন্তর্জগতে ঠাঁই পাওয়া এমনই কিছু গল্প নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কলাকেন্দ্রে শুরু হয়েছেসময়ের গল্প শিরোনামে একটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। শিল্পী হাবীবুর রহমানের আঁকা ৫০টিরও বেশি চিত্রকর্ম ঠাঁই পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনীটি মূলতড্রইং অ্যান্ড থিংকিং, থিংকিং অ্যান্ড ড্রইং শিরোনামে কলাকেন্দ্র আয়োজিত ধারাবাহিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর বিশেষ এক আয়োজন। সময়ের গল্প শিরোনামে শিল্পী হাবীবুর রহমানের প্রদর্শনীটি এ বিষয়ের নবম আয়োজন। আয়োজকদের ভাষ্য, শিল্পীর চিন্তা ও অবস্থানকে পড়ার, বোঝার ও জানার তাগিদেই তারা নিয়মিত এ রকম প্রদর্শনীর আয়োজন করে চলেছেন।

সময়ের গল্প শীর্ষক প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোয় রঙ, অবয়ববিহীন সময়ের যে গল্প শিল্পী হাবীবুর রহমান এতকাল ধারণ করেছেন নিজের অন্তর্জগতে, তিনি কেন সেসব গল্পকে ফ্রেমবন্দি করলেন, রূপ দিলেন চিত্রকর্মে? টকিজ এমন প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিল শিল্পী হাবীবুর রহমানের। তার ভাষ্য, ‘আশেপাশে এ সময়ে যা ঘটছে অথবা আমি যা পড়ছি বা শুনছি, সবটাই আমার স্মৃতি-বিস্মৃতিতে রয়ে যায়। ড্রইং শুরু করি কোনো একটা অবয়ব থেকে। তারপর তা আপনা থেকেই কাটাকাটির মাধ্যমে বাড়তে থাকে। রেখাই আমার ড্রইংয়ের মূল। সঙ্গে থাকে আলো-আঁধারের খেলা। চেষ্টা করি তাতে অর্থ ও সুর দিতে। এই হচ্ছে আমার সময়ের গল্প, যা ড্রইংয়ের মাধ্যমে রূপ পেতে পেতে অনেক ঘটনার অনেক স্মৃতিকে ছুঁয়ে যায়।

শিল্পীর কাছে পরের প্রশ্ন: সময় ও গল্পের যূথবদ্ধ এগিয়ে চলা নিয়ে আপনার ভাষ্য কী? ‘আসলে আমরা যখনই কোনো কথা বলছি, তাও কিন্তু সময়ের গল্প। একটু পর এ সময়টা আর থাকবে না। যে সময়টা আসছে, সে সময়টা আবার চলেও যাচ্ছে। এভাবে প্রতিটি ঘটনাই যখন মানুষ দেখছে, উপভোগ করছে, তার সবটাই সময়ের গল্প। এর মধ্যে রাজনীতি, রাষ্ট্র কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও থাকতে পারে।

এ প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া চিত্রকর্মগুলোর বিশেষত্ব হলো, এর বেশির ভাগই কালি ও কলম দিয়ে এঁকেছেন শিল্পী হাবীবুর রহমান। কেন এমনটা? ‘সরল উত্তর হলো, কলম খুবই সহজলভ্য। লেখাপড়া শুরুর পর থেকে কলম আমার নিত্যসঙ্গী ছিল। বিশেষ করে কলমের কালো কালি আমার খুব পছন্দের একটা রঙ। এ কারণে  প্রদর্শনীটির চিত্রকর্মগুলোর কিছুতে কালো রঙের ব্যবহার আছে। আসলে কালো রঙের অনেক অর্থ। কোথাও এর অর্থ খারাপ, কোথাও ভালো। বৈপরীত্যএ বিষয়টিও আমাকে টানে।

সময়ের গল্পের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুর উপস্থাপন নিয়ে শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ তার মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘রেখায় আকীর্ণ-বিকীর্ণ হাবীবের ছবি। বলা যায়, প্রধানত রেখার প্রকীর্ণ প্রয়োগে ইমেজ পরস্ফুিটিত হয়েছে। মানুষের দেহে মানুষের ইমেজ, কখনোবা অন্য প্রাণীর; প্রাণের বিজারিত যে দৃশ্যমানতা এ জগৎ-সংসারে প্রতিদিন দেখে চলেছি, তাই লীলাময়-রহস্যময় হয়ে উঠেছে শিল্পীর চিত্রতলে। তাছাড়া মানুষ ও প্রাণীর সহাবস্থানের কোনো এক আদিম ডাকও হাবীবের সৃজনচেতনাকে শিহরিত করেছে বলে মনে হয়। কালো রেখার আকুলি-বিকুলি ও লালচে বর্ণ-ছোপের সম্মিলনের ফলে আমরা আদিমতার অথবা চিরায়তের ঘ্রাণ নিতে পারি হাবীবের ছবি থেকে।

সময়ের গল্প শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনিও গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন চিত্রকর্মগুলোর অবয়ব। চিত্রকর্মগুলো নিয়ে ওয়াকিলুর রহমানের গভীর পর্যবেক্ষণের ছাপ ব্যক্ত হয়েছে তার এ বক্তব্যে, ‘শিল্পী হাবীবের চিত্রচর্চার উপকরণ সাদামাটা ও গতানুগতিক। তবে ধ্যানমগ্ন, নির্লিপ্ত, অনুচ্চকিত, মনোযোগী, সূক্ষ্ম ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রেখায়, ফর্মে, গঠনে, ছোট্ট পরিসরে যে বিশাল কল্পচিত্র তৈরি করেন বা করার ক্ষমতা দেখান, তা নান্দনিক, অভিনব এবং স্বকীয়। তিনি আরো বলেন, ‘দেহ-মন-প্রকৃতি ও অস্তিত্বের যে ধারণা, অভিজ্ঞতা, দ্বন্দ্ব, সংলাপ, তা হাবীবের কাজে উচ্চারিত হয় বুদ্ধিদীপ্ত ও সংবেদনশীলতা নিয়ে। স্তরের পর স্তরে, ব্যক্তিগত হয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক... যা কিনা একাধিক পথের, সময়ের মানচিত্র।

সময়ের গল্প শিরোনামের এ শিল্প প্রদর্শনী চলবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। গতকাল শুরু হওয়া প্রদর্শনীটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী ও শিল্পানুরাগী মাহমুদুল হেলাল।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন