অভিমত

পেঁয়াজের আবাদ বাড়াতে করণীয়

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

সব ধরনের মাটিতেই কমবেশি পেঁয়াজ জন্মে। এদিকে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় হলো ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। সময় ও অঞ্চলভেদে পেঁয়াজের চাষকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সাধারণত পেঁয়াজ ভারত, চীন, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভুটানসহ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে জন্মে। ভারতের মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি জন্মে। আর বাংলাদেশের পাবনা ও ফরিদপুরে অধিক পেঁয়াজ জন্মে। আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় প্রায় ২২ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পেঁয়াজ পচে যায়। চাহিদা অনুযায়ী সব মিলিয়ে ঘাটতি থাকে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টন। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন ভ্যারাইটি হলো বারি পেঁয়াজ-১। এর একেকটি কন্দের ওজন প্রায় ৬০-৮০ গ্রাম। যাহোক, সব জেলায় চাষ হলেও বৃহত্তর ফরিদপুর ও পাবনা জেলা থেকে দেশের সিংহভাগ পেঁয়াজের সরবরাহ হয়। বিভিন্ন জেলায় কমবেশি চাষাবাদ সত্ত্বেও পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন দেশের চাহিদার তুলনায় কম। চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

দুই. আগেই বলেছি চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতি বছর চাহিদা অনুযায়ী বড় একটা পরিমাণ ঘাটতি থাকে বিধায় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ ঘাটতি পূরণে পার্শ্ববর্তী দেশ, বিশেষ করে ভারত থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। আর এটাই হয়েছে কাল। কেননা গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে জনৈক মনীষীর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘সব টাকা এক পকেটে রাখতে নেই। যাহোক, এ পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় ফণী এবং এর কয়েক মাসের ব্যবধানের বুলবুল সংঘটিত হয়। এই দু-দুটো দুর্যোগ পেঁয়াজ উৎপাদনের অতখানি ক্ষতি না করলেও ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কিছুদিন আগে বেশ কয়েক দিন লাগাতার বৃষ্টি হয়, যা ভারত ও বাংলাদেশের পেঁয়াজ উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত করে। এ কারণে নিজস্ব চাহিদা মেটাতে ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বুঝতে পেরে অতিরিক্ত লাভের আশায় সিন্ডিকেট তৈরি করে বসে। এটা সত্য, পেঁয়াজের ঘাটতি থাকলেও এর মূল্য এত বাড়ার কথা ছিল না। নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব অনুযায়ী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মজুদ না করে সারা দেশে সঠিকভাবে বণ্টিত হলে পেঁয়াজের সরবরাহ কম হলেও এত বাড়ার কথা ছিল না। যাহোক, ঢাকাসহ সারা দেশে পেঁয়াজের মূল্য গ্যালোপিং আকারে হু-হু করে বেড়ে যায়। কোথাও কোথাও পেঁয়াজের সংকটও সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই বাণিজ্যনীতির কথা উঠে আসে। উল্লেখ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঠিক সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত না নেয়া, ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা পেঁয়াজের বাজার লাগামহীন হয়ে ওঠার কারণ বলে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এদিকে পেঁয়াজের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে ভোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। শহর, বন্দর, গ্রাম ও অফিসপাড়ায় কেবল পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। ঢাকায় পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। রাজধানীর বাইরেও পেঁয়াজের বাজার ছিল উল্টাপাল্টা। অধিকাংশ জেলায় ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলেও তেমন কার্যকর হয় না। অনেক মার্কেট বিশেষজ্ঞ এই মর্মে অভিমত পোষণ করেন, ভারত রফতানি বন্ধ করার ফলেই এ নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য বিশেষ কিছু সুবিধাদানের ঘোষণা দেয়। এতে এলসি মার্জিন কমানোসহ আরো কিছু সুবিধা ছিল। একই সঙ্গে খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের শাস্তিমূলক জরিমানা করা হলে তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে ব্যবসা বন্ধ দেন। আর কতিপয় ব্যবসায়ী জরিমানার টাকা তুলতে আরো বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেন। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় ভারত রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার অব্যবহিত পরই বাংলাদেশে ৪০-৪৫ টাকা দামের পেঁয়াজ হঠাৎ করে দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায়। তারপর জ্যামিতিক গতিতে বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের উদ্যোগ নিলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় না। যদিও সম্প্রতি এনবিআর পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজির ব্যাপারে ৩৪১টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় এনেছে। যাহোক, এ অবস্থা থেকে আপাতত পরিত্রাণ পেতে অধিক অর্থ ব্যয় করে চীন, মিসর, মিয়ানমার থেকে উড়োজাহাজে পেঁয়াজ আনা শুরু হয়। এর মধ্যে সরকার ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে ভর্তুকি দিয়ে টিসিবির মাধ্যমে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করছে। বর্তমানে অবশ্য এর মূল্য নিম্নগামী। কিন্তু যতটা কমার কথা ছিল, অতটা কমেনি। তাছাড়া বাড়তি মূল্য বেশ ওঠানামা করছে।

তিন. পেঁয়াজের এই অতিরিক্ত মূল্যের বিষয়ে হইচই বা হা-হুতাশ করার কোনো কারণ নেই। তরকারিতে পেঁয়াজ ব্যবহার না করলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমন কোনো কিছু নয়। কেননা সাধারণত আমরা যে শাকসবজি খেয়ে থাকি, তার মধ্যে পেঁয়াজের গুণাগুণ বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশের রান্নাবান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার বলতে গেলে একটি কালচারের আওতাভুক্ত বিধায় আমরা সহজে মানতে চাই না। এটা সত্য, বাস্তবমুখী কতগুলো ব্যবস্থা নিলে হয়তো পেঁয়াজ নিয়ে এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে না। প্রথমত, আমাদের দেশে সঠিকভাবে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমদানিতব্য সময়, আবহাওয়া ও দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে সঠিক বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষ একটি দেশকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানির ক্ষেত্রে অন্য দেশকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে দুঃখের বিষয় হলো, এ বিশ্বের অনেক দেশে মোটেই পেঁয়াজ জন্মে না। অথচ সেসব দেশে এর দাম বাড়েনি। উদ্ভূত সময় বিবেচনা করে যদি সমুদ্রগামী জাহাজে আমদানি করা হতো, তাহলে আমাদের দেশে এ অবস্থা হতো না। তাছাড়া এত টাকা ব্যয় করে উড়োজাহাজেও আনার প্রশ্ন উঠত না। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। চতুর্থত, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূণতা আনতে উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের চাষ করতে হবে। প্রয়োজনে অধিক জমি পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে যে পেঁয়াজ চাষের জন্য আহামরি কোনো ব্যবস্থার দরকার হয় না। আর পেঁয়াজের উপযোগী মৃত্তিকা বিবেচনা করলে, বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলেই পেঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। পঞ্চমত, রান্নাবান্নায় সবসময়ই যে পেঁয়াজ ব্যবহার করতে হবে, সেই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। কেননা আমাদের দেহের জন্য পেঁয়াজ থেকে যে উপাদান পাই (যেমন প্রোটিন, শর্করা, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন ইত্যাদি), তার বিকল্প হিসেবে অন্য শাকসবজি থেকে পেতে পারি। এরই মধ্যে বিকল্প হিসেবে কাঁচা পেঁপে, মুলা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, বাঁধাকপি ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই পরিশেষে বলতে চাই, এবার পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিক হলেও এটি একটি নেতিবাচক খণ্ডচিত্র মাত্র। বর্ণিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাই যদি তত্পর তথা এগিয়ে আসি, তাহলে পেঁয়াজের ঘাটতি তো থাকবেই না, বরং বিদেশে রফতানি করার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেহেতু এ নিয়ে অযথা হইচই না করে যাতে আগামীতে আর এ ধরনের নাজুক অবস্থার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে মনোনিবেশ করা সমীচীন বলে মনে করি।

 

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব: গবেষক ও রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন