খ্যাতিমানদের প্লেগমরণ

ইবনে মোতালিব

পেরিক্লেস
গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লেস (জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ অব্দ, মৃত্যু খিস্টপূর্ব ৪২৯ অব্দ) ইতালির স্বর্ণযুগের কীর্তিমান পুরুষ, যে সময়টা তিনি এথেন্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৬১ থেকে ৪২৯—ঐতিহাসিকরা এটাকেই অ্যাখ্যা দিয়েছেন ‘পেরিক্লেস যুগ’। এ যুগের অর্জন ম্লান করে দেয় কালো মৃত্যু। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে এথেন্স শহরে মহামড়ক দেখা দেয় এবং শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদেরই একজন এথেন্সপ্রধান পেরিক্লেস। মহামারী শুরুর দ্বিতীয় বছর তার মৃত্যু হয়।
মড়কের সময় এথেন্সে গণকবর দেয়া হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কেরামিওকোর্সে প্রাচীন কবরস্থান খনন করে একটি কবরে কমপক্ষে ১৫০ মরদেহ ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা তখনকার রোগটিকে একসময় প্লেগ বললেও এখন বলছেন, প্লেগ নয়, টাইফয়েড। তারা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মারা যাওয়া মানুষের দাঁত তুলে নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন।
অবশ্য প্লেগ মানেই যে কেবল প্লেগ রোগ হতে হবে তা নয়, যেকোনো মহামড়কই তো প্লেগ নামে পরিচিত।
খননকারীরা মরদেহের অবস্থান থেকে নিশ্চিত হন, ভীষণ অমর্যাদার সঙ্গে তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর স্তূপীকৃত করা হয়েছে।
হোস্টিলিয়ন
রোমান সম্রাট হোস্টিলিয়ন প্লেগমৃত্যুর শিকার হওয়ায় শাসনের ছয় মাসও পূর্ণ করতে পারেননি। ২৫১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি বড় ভাইয়ের সহমসনদধারী হন এবং নভেম্বরেই প্লেগের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তার আগেই ট্রেতোনিয়ানাস গ্যালাস হোস্টিলিয়নের ভাই হেরেনিয়াসকে হত্যা করে নিজে সহসম্রাট হন। এ কালের বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন হোস্টিলিয়নও তারই হাতে নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই বলেছেন প্লেগে তার মৃত্যু হয়েছে।
কনস্টান্টিনোস কপ্রোনিমাস
তিনি বাইজেনন্টাইন সম্রাট পঞ্চম কনস্টান্টিন। তার রাজত্বকাল ৭৪১ থেকে ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ। তিনি রণকৌশলের জন্য বিখ্যাত, বলকান অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সনাতন খ্রিস্টীয় যাজকবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি পাপিষ্ঠ হিসেবে ‘অসম্মানিত হন’। ৭৭৫ সালে প্লেগে তার মৃত্যু হলে তার মরদেহ সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা হয়।
নবম লুই, ফ্লান্সের রাজা
নবম লুই (১২১৪-৭০) ৮ নভেম্বর ১২২৬ থেকে ২৫ আগস্ট ১২৭০ মৃত্যু পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ফরাসি রাজাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সন্ত হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন। তিনি আটটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ করেছেন।
সপ্তম ক্রুসেডের সময় মিসরে পরাজিত ও বন্দি হলে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান। অষ্টম ক্রুসেডের সময় তিউনিসিয়ায় অনেক সৈনিকের সঙ্গে তিনিও প্লেগে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তার হিপণ্ড ও অন্ত্র তার ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে সমাহিত করা হয়। দেহ থেকে মাংস পৃথক করে তার হাড় ফ্রান্সে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর কারণ আমাশয় মড়ক বলে উল্লেখ করা হয়। আলংকারিক অর্থে প্লেগ মানেই মহামড়ক।
শিল্পী টিশ্যান
প্লেগ তখন ইতালির ভেনিস ছারখার করে ফেলছে। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হলেন সেরা চিত্রশিল্পী টিশ্যান। ২৭ আগস্ট ১৫৭৬ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রঙের জাদুকর টিশ্যানের হাতে ‘স্লিপিং ভেনাস’, ‘দ্য অব উরবিনো’ কিংবা ‘উইম্যান উইথ আ মিরর’-এর মতো ছবি অঙ্কিত হয়েছে। পরিণত বয়সে টিশ্যান বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এখন পেইন্টিং সম্পর্কে কিছু শিখতে শুরু করেছি।’ এই শিল্পীর মৃত্যু প্লেগে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।
শেক্সপিয়ার পরিবার
শেক্সপিয়ার প্লেগের রাহু এড়াতে পেরেছেন, পারেননি তার দুই বোন মার্গারেট জোয়ান ও অ্যানি, ভাই ১৭ বছর বয়সী এডমন্ড এবং তার ১১ বছর বয়সী ছেলে হ্যামলেট প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার ল্যান্ডলেডি ম্যারি মাউন্টজয়ও প্লেগের শিকার হন। তার বন্ধুদের কেউ কেউ রক্ষা পেলেও অনেকেই স্বজনসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। তার রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ কালো মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। প্লেগের কারণে বহু থিয়েটার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
জিওভান্নি বোক্কাচ্চিওর পরিবার
ইতালীয় বিশ্বখ্যাত কবি ও লেখক জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও প্লেগ এড়াতে কিছু সময় পালিয়ে বেড়ালেও প্লেগ যন্ত্রণার সাক্ষী হিসেবে রচনা করতে পেরেছেন ডেকামেরনের মতো উপন্যাস। বোক্কাচ্চিওকে মনে করা হয় ইউরোপীয় উপন্যাসের জনক। তার উপন্যাসটি মূলত ফ্লোরেন্সের প্লেগ থেকে বেঁচে যাওয়া কজন মানুষের কাহিনী।
বাস্তব জীবনে প্লেগ কেড়ে নিয়েছে তার বাবাকে, তার সত্মায়ের মৃত্যুর কারণও তাই।
নস্ট্রাডামুসের পরিবার
ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিকিত্সক ও ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডামুস হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, প্লেগ তাকে স্পর্শ করেনি। সফল চিকিত্সক হিসেবে তিনি যখন প্লেগ রোগীর চিকিত্সায় ব্যস্ত, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এতে ব্যক্তিগত যাতনা ছাড়া তার সামাজিক সম্মানও ক্ষুণ্ন হয়। বিয়ের সময় তিনি যে যৌতুক নিয়ে ছিলেন, তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
ইতালির বিখ্যাত ভাস্কর ও স্থপতি আন্দ্রেয়া পিসানোর মৃত্যুর কারণ কারো কারো মতে প্লেগ। মৃত্যুর সময়টা ১৩৪৮ সাল; সে সময় ইতালিতে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে। পিসানোর বড় অবদান ইতালির ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে বাইজেন্টাইন প্রভাব থেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
চিত্রশিল্পী জর্জিয়ন, হ্যান্স হলবিন দ্য ইয়ঙ্গার, সুরকার ফ্রান্সেসকো গুয়েরেরো, কসভোর আর্চবিশপ পিটার বোদানিকেও প্লেগমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে।

ইবনে মোতালিব: লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন