বিশ্বসাহিত্যে প্লেগ

শানজিদ অর্ণব

প্লেগ মধ্যযুগে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষকে হত্যা করেছিল। চৌদ্দ শতকে প্লেগের আক্রমণে দুনিয়ায় যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছিল, সেই মৃত জনসংখ্যা নতুন মানুষ দিয়ে পূরণ হতে সময় লেগেছিল দু-দুটো শতক। মানব ইতিহাসে প্লেগের প্রভাব বুঝতে পরিসংখ্যানই যথেষ্ট, আর কোনো কথা না বললেও চলে। উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত মাঝে মধ্যেই প্লেগের মহামারী ইউরোপকে বিধ্বস্ত করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই চৌদ্দ শতকে ইউরোপে প্লেগের বিনাশী ভূমিকা ইউরোপীয় সংস্কৃতি, মৃত্যুর ধারণা, জীবনদর্শন এমনকি ধর্মশাস্ত্রকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সে সময় এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় শিল্প, সাহিত্যে অহরহ চিত্রিত হয়েছে প্লেগজনিত দুর্দশা, ব্যঙ্গ এমনকি আশাও। সবকিছুর মূলে ছিল মৃত্যুঘুরেফিরে নানা চেহারায় এসেছে মৃত্যুর চেহারা। না এসেই বা কী উপায় ছিলমৃত্যু যে চারপাশে, কাকে কখন নিয়ে যায় কে জানে!

চৌদ্দ থেকে ষোলো শতকজুড়ে ইউরোপের শিল্প ছিল অনিশ্চিতজাতিগত আধিপত্য, সামরিক অভিযান ধর্মীয় দর্শনের নিত্যপরিবর্তন-রূপান্তর শিল্পচর্চার অভিমুখকেও বদলে দিত। সম্রাট কনস্ট্যানটাইনের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর ইউরোপ খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির প্রতি উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং শিল্পচর্চায় এর প্রভাব দেখা যায় পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে। মধ্যযুগের চিত্রকররা বাস্তব জীবনকে এড়িয়ে চলেছেন; গির্জা কিংবা মঠের দেয়ালে তারা আঁকতেন বিবলিক্যাল ঘটনাবলি কিংবা খ্রিস্টীয় সন্তদের চিত্রকর্ম। আরো ছিল একই ধরনের ভাস্কর্য খোদাইকর্ম। এসব শিল্পকর্মের অনেকগুলোতেই দেখা যেত মৃত্যুর উপস্থাপনামৃত্যুকে দেখা হতো ধরণিতে জীবন স্বর্গে আরোহণের পথ হিসেবে। কিন্তু প্লেগ মৃত্যু সম্পর্কে ইউরোপের শিল্পী তথা খ্রিস্টীয় ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। প্লেগের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত্যুকে এবার ত্রাস হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হলোমৃত্যু হয়ে উঠল ঈশ্বরের শাস্তি!

ভবন নির্মাণের রীতিতে প্রভাব ফেলেছিল প্লেগ। ধনীরা তাদের বাড়ি, রাজারা তাদের দুর্গ আরো সুরক্ষিত করে তুলেছিলেন প্লেগ থেকে বাঁচতে।

প্লেগ ইউরোপীয় চিত্র শিল্পে রিয়ালিজমকে শক্তিশালীভাবে যুক্ত করে। নরকের ভয় ভয়ানক এক বাস্তবতা হয়ে ওঠে, বিপরীতক্রমে স্বর্গের প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছ থেকে দূরাগত হতে থাকে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে মৃত্যুকে দেখতে পায় ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতেসবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল নিজের পাপ মুক্তির জন্য। শিক্ষিতরা মন দিয়েছিলে বাইবেলের পাতায় এবং নিশ্চিত করতে চাইছিলেন বোনা মোরস (সুন্দর মৃত্যু) অনেকে জীবিত থাকতেই এটা নিশ্চিত করতে চাইছিলেন যে তাদের শবযাত্রা সমাধিটি যেন অভিজাত হয়।

চৌদ্দ শতকের পর সতেরো শতকেও প্লেগ সর্বগ্রাসী ভীতিকর দিন বয়ে এনেছিল ইউরোপের মানুষের জন্য। ১৬৬৫ সালে লন্ডনে প্লেগের আক্রমণে প্রাণ হারায় প্রায় এক লাখ মানুষ। পুরো লন্ডন হয়ে উঠেছিল এক গোরস্থান, আতঙ্কের নগরী। যেন মিসরের ফ্যারোর ওপর ধেয়ে আসা ঈশ্বরের অভিশাপের মতো, যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা লন্ডনবাসীর ছিল না। শুধু ছিল মৃত্যুর অপেক্ষানিজের কিংবা স্বজনের।

ইউরোপীয় চিত্রকর্ম, ধর্মীয় চিন্তার পাশাপাশি সাহিত্যে দেখা যায় প্লেগের গভীর প্রভাব। লন্ডনে ১৬৬৫ সালে প্লেগের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী পাওয়া যায় স্যামুয়েল পেপিজের (১৬৩৩-১৭০৩) দিনলিপি থেকে। পেপিজ ছিলেন ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা পার্লামেন্টের সদস্য। ১৬৬০-৬৯ সময়ে পেপিজ দিনলিপি লিখেছেন। তার দিনলিপি ইংলিশ রিস্টোরেশন কালপর্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক দলিলগুলোর অন্যতম। দিনলিপিতে পাওয়া যায় ১৬৬৫ সালের প্লেগ, দ্বিতীয় ওলন্দাজ যুদ্ধ লন্ডনে আগুন লাগার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। পেপিজ ১৬৬৫ সালের জুন তার দিনলিপিতে লিখেছেন, আজ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ড্রুরি লেনে গিয়েছিলাম। সেখানে দু-তিনটা বাড়ির দরজায় লাল রঙের ক্রুশ এঁকে চিহ্নিত করা এবং লেখা ঈশ্বর আমাদের করুণা করুন দৃশ্য থেকে মন খারাপ হয়েছে, রকম দৃশ্য আমি জীবনে এই প্রথমবার দেখলাম।

বোক্কাচ্চিও তার বিখ্যাত ডেকামেরনে প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন দারুণ মুনশিয়ানায়। ১৩৪৮ সালে প্লেগ আঘাত হেনেছিল ইতালির ফ্লোরেন্সে। লাখখানেক ফ্লোরেন্সবাসীর জীবন গিয়েছিল সেবার। তবে প্রমাণ আছে যে ১৩৪৮ সালে বোক্কাচ্চিও ফ্লোরেন্সে ছিলেন না, বরং সে বছর তিনি ছিলেন নেপলসে। তিনি অন্যদের মুখে শুনে সেই বর্ণনা অনুসারে তার বিবরণী লিখেছিলেন। এও সত্য যে বোক্কাচ্চিও প্লেগের আক্রমণ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতেন। কারণ কথিত আছে যে তার বাবা প্লেগেই মারা গিয়েছিলেন।

মধ্যযুগে ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি জিওফ্রে চসার তার বিখ্যাত ক্যান্টারবারি টেলসেও প্লেগের প্রসঙ্গ এনেছেন। চসারের ম্যাগনাম ওপাসের গঠনে বোক্কাচ্চিওর ডেকামেরনের প্রভাব খুঁজে পান সমালোচকরা। ১৩৭২ সালে চসার ইতালি গিয়েছিলেন কূটনৈতিক মিশনে। সেখানেই তিনি ডেকামেরন সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সে সফরে চসারের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল পেত্রার্কের এবং পেত্রার্ক ছিলেন বোক্কাচ্চিওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ক্যান্টারবারি টেলসের পারডোনার টেলে পাওয়া যায় প্লেগের বিবরণ। খুব গভীর না হলেও অংশে পাঠক প্লেগের পরিষ্কার চিত্র দেখতে পান। যে মহামারীর বর্ণনা চসার দিয়েছেন, সেটা সংঘটিত হয়েছিল তৃতীয় এডওয়ার্ডের আমলে। চসার যে প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা সংঘটিত হয়েছিল ১৩৪৮ সালে।

১৩৫৭ সালে ইউরোপে প্লেগের মহামারী দেখা দেয়। সে সময় ফ্রান্সের মপেলিয়েঁ বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচার্য জ্যাঁ জ্যাসম প্লেগ থেকে সুরক্ষাবিধি নিরাময়ের উপায় বর্ণনা করে কাব্যের ছন্দে একটি রচনা লিখেছিলেন। এর প্রাথমিক প্রভাব নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। প্লেগ সুইডেনে হাজির হয় ১৪৫০ সালে, পরবর্তী পাঁচ বছর মহামারী দেশটির জনগণকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তবে সবচেয়ে ভয়ানক আক্রমণটি হয় ১৪৬৪ ১৪৬৫ সালে। বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সুইডিশ বিশপ বেনগ্ট নাটসন জ্যাঁ জ্যাসমের প্লেগসংক্রান্ত ফরাসি কবিতার লাতিন সংস্করণ প্রকাশ করেন। সংস্করণটি নাটসনের লাতিন রূপ ক্যানুটাস নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

নাট্যকাররাও প্লেগের বিভীষিকাকে তাদের কাহিনীর নাটকীয়তা বাড়াতে ব্যবহার করেছেন। ইতিহাসে সম্ভবত গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেস প্লেগকে প্রথমবারের মতো নাটকে ব্যবহার করেছিলেন। তার ট্র্যাজেডি কিং অয়েদিপাসে তিনি কাহিনীতে ব্যবহার করেছেন প্লেগের অভিশাপ। ইংরেজ স্যাটায়ারিস্ট টমাস নাশে (১৫৬৭-১৬০১) তার নাটক সামারস লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্টে যুক্ত করেছেন প্লেগ মহামারী। টমাস নাটক লিখেছিলেন ১৫৯২ সালে এবং সম্ভবত এর প্রথম মঞ্চায়নও হয়েছিল সে বছরই। বেন জনসন তার বিখ্যাত নাটক দি আলকেমিস্টে প্লেগকে ব্যবহার করেছেন। তিনি নাটক রচনা করেছিলেন ১৬১০ সালে এবং এটা ছিল প্লেগের আক্রমণে ইউরোপের জন্য বিভীষিকাময় একটি বছর।

১৬৬৫-৬৬ সময়ে লন্ডনে প্লেগের যে আক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তা গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন নামে খ্যাত। মাত্র ১৮ মাসে এক লাখ লন্ডনবাসী প্রাণ হারিয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের লন্ডনের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। লন্ডনে ১৬৬৫ সালে সে প্লেগের অভিশাপ কেমন ছিল, তার সেরা চিত্রায়ণটি করে গেছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ড্যানিয়েল ডিফো এবং সম্ভবত প্লেগ নিয়ে সাহিত্যে এটিই শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৭২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ড্যানিয়েল ডিফোর উপন্যাস জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার। ঐতিহাসিক উপন্যাসে ড্যানিয়েল ডিফো এক প্রতক্ষদর্শী বক্তার বয়ানে দেখিয়েছেন ১৬৬৫ সালে লন্ডনে প্লেগের বিভীষিকা, বিরান সড়ক, অলিগলি, প্লেগে মৃত মানুষের বাড়ির দরজায় এঁকে দেয়া ক্রুশ। ডিফোর বক্তা বলেছেন মানুষের আতঙ্ক, বিচ্ছিন্নতা আর হিস্টিরিয়ার কথা। পুরো উপন্যাসের বা জার্নালের শেষে প্রথম শেষবারের মতো ডিফো বক্তার পরিচয় দিয়েছেনশুধু নামের দুটো আদ্যাক্ষর: এইচএফ। কে ছিলেন এই এইচএফ? ড্যানিয়েল ডিফোর একজন চাচার নাম ছিল হেনরি ফো। ১৬৬৫ সালে প্লেগের দিনগুলোয় হেনরি লন্ডনে ছিলেন। তার কাছ থেকে ডিফো নিশ্চিতভাবেই লন্ডনে প্লেগের ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলেন, যা তিনি তার উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন।

ড্যানিয়েল ডিফোর জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার উপন্যাসটি শুরু করেছেন এভাবে—‘সময়টা ছিল ১৬৬৪ সালের সেপ্টেম্বর, শুনতে পেলাম যে হল্যান্ডে প্লেগ ফিরে এসেছে। সেখানে মহামারী ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, বিশেষত আমস্টারডাম রটারডামে।...কেউ বলেন প্লেগ এসেছে ইতালি থেকে... আর উপন্যাসের শেষ হয়েছে চার লাইনের এক কবিতার ছন্দে:

ভয়ানক এক প্লেগ লন্ডন আক্রমণ করেছিল

পঁয়ষট্টি সালে

কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের জীবন

তার পরও আমি গেছি বেঁচে! এইচএফ

ডিফোর জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার উপন্যাসটি এত জীবন্ত প্রামাণিকভাবে লন্ডনের প্লেগের বিবরণী উপস্থাপন করেছিল যে প্রকাশের পর এটিকে নন-ফিকশন হিসেবে পড়া হতো। ১৭৮০-এর দশকে বইটি উপন্যাস হিসেবে গৃহীত হয়। তার পরও ইতিহাসবিদরা সে সময়ের লন্ডন প্লেগ নিয়ে গবেষণায় ডিফোর উপন্যাসটি অহরহ ব্যবহার করেন। 

 

শানজিদ অর্ণব: লেখক সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন