প্লেগ ও ইউরোপের উইচ-হান্টিং

মণিদীপা দে

১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা প্লেগ মহামারী ইউরোপকে গ্রাস করে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে প্লেগ গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে উইচ-হান্টিংয়ের পেছনেও এ প্লেগ মহামারীর প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।
ব্ল্যাক ডেথের এ সুদূরপ্রসারী প্রভাবের পেছনে তিনটি মূল কারণ আছে। প্রথমত,  প্লেগে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অজস্র মৃত্যু। এ ভয়ংকর মৃত্যুগুলোর সঠিক কারণ না বুঝতে পারায় সাধারণ মানুষের মনে এক তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সেসব আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে সাহস দিতে সমাজের শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিরা বলির পাঁঠা করেন সমাজের দুর্বল বা প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষকে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইহুদি সম্প্রদায়, যাদের সমাজ বিশেষ সুনজরে দেখত না। দ্বিতীয়ত, প্লেগে জনসংখ্যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে এমন উচ্চহারে হ্রাস পায়, যা থেকে একাধিক সামাজিক বিপ্লবের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় (যেমন: কৃষক বিপ্লব, জমিদারি বা ফিউডাল ব্যবস্থার পতনের শুরু ইত্যাদি)। ইউরোপীয় সমাজ রীতিমতো আলোড়িত হয়ে পড়ে এসব পরিবর্তনের ধাক্কায়। তৃতীয় আরেকটি প্রবণতা দেখা দেয় সাধারণ মানুষের মধ্যে, তা হলো সমাজের শাসকশ্রেণীর মানুষদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষও তৈরি করে তাদের নিজস্ব উইচ-হান্টারের দল। এ নিজস্ব উইচ-হান্টারের দল তদন্তের উসিলায় যথেচ্ছ অত্যাচার, লুটতরাজ এবং মানুষ খুন করতে শুরু করে।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, প্লেগের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় সমাজে যে তীব্র আলোড়ন ও পরিবর্তন আসে, তার বেশকিছু ইতিবাচক দিক আছে—রেনেসাঁ বা রিফরমেশনের যুগ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এ আলোকোজ্জ্বল রেনেসাঁ বা নবজাগরণ আসার আগে এসেছিল এক দীর্ঘকালব্যাপী বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা ও হিংসার কালরাত্রি।
প্লেগ রোগের শুরুটা হয়েছিল মধ্য এশিয়ায় এবং তা বাণিজ্য পথ ধরে দ্রুত পশ্চিমের দেশগুলোর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৩৪৭ সালে প্লেগ তার মহামারী রূপ নিয়ে পৌঁছে কনস্ট্যান্টিনোপল ও ভূমধ্যসাগরের পাশের দেশগুলোয়। ১৩৪৮ সালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে। প্লেগ রোগটা বয়ে বেড়াত এক ধরনের উপমক্ষিকা বা অতি ক্ষুদ্র পোকা (ফ্লি), যেগুলো থাকত ইঁদুরের গায়ে। বাণিজ্য জাহাজে চেপে এসব ইঁদুর প্লেগ পৌঁছে দিত ইউরোপীয় দেশগুলোয়। সাংঘাতিক ছোঁয়াচে এ রোগ শুধু দ্রুত ছড়াত না, রোগীকে মেরেও ফেলত খুব তাড়াতাড়ি। তিনদিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মৃত্যু ছিল প্রায় অবধারিত। সে সময় খুব কম লোকই প্লেগ থেকে সেরে উঠত। তখন একটা কথা চালু হয়, প্লেগের রোগীরা প্রাতরাশ করে পরিবারের লোকদের সঙ্গে আর রাতের খাবার খায় প্রেতলোকে, তার মৃত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে। 
আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ এ সময় মারা যায় প্লেগে আক্রান্ত হয়ে এবং তখনকার চিকিত্সকরা কিছুতেই এ রোগের মূল কারণটা ধরতে পারেননি। রোগটা  এতটাই হঠাত্ করে শুরু হতো যে অনেক সময় মনে হতো যে বিনা কারণেই হয়েছে। তার ওপর যখন মানুষ দেখত যে কোনো প্রিয়জন তার চোখের সামনে, বিনা কারণে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মারা গেল, তখন আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে কুসংস্কার দেখা দিতে শুরু করল—যে রোগের কোনো আপাতত কারণ নেই, সেই রোগ নিশ্চয় কোনো শয়তানের কাজ। এর থেকেই শুরু হলো সেই শয়তানের প্রতিনিধিদের খুঁজে বের করা এবং তাদের নৃশংসভাবে খুন করা।
ইউরোপে প্লেগসংশ্লিষ্ট উইচ-হান্টিংয়ের প্রথম শিকার হয় ইহুদিরা। ১৩৪৮-এর শুরুতেই  pestis manufacta  অর্থাত্ ‘শয়তান-সৃষ্ট রোগ’ নিয়ে একটা ত্রাস তৈরি হয়। গুজব রটে যায় যে ইহুদিরা ইচ্ছা করে প্লেগ ছড়াচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মকে শেষ করার জন্য। শুরু হয় ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন। অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে নিরুপায় হয়ে তারা যখন মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেয় যে তারাই এ রোগের জন্য দায়ী, তখন এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপজুড়ে শুরু হয় ইহুদিদের আটক এবং হত্যা করা।  ১৩৪৮-এর ‘পাম-সানডে’র দিন (অর্থাত্ গুড ফ্রাইডের আগের রোববার) ট্যুলন শহরে ৪০ জন ঘুমন্ত ইহুদিকে পুড়িয়ে মারা হয়। একই বছরে মে মাসে, কার্কাসন্নে ও নারবন্নে শহরের সব ইহুদিকে মেরে ফেলা হয়। ১৩৪৯-এর জানুয়ারি বাজেল শহরে ২০০ জন ইহুদিকে একটা গোলাঘরে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়; আর স্ট্রাসবুর্গে ৯০০ জন ইহুদিকে পুড়িয়ে মেরে বাকিদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। এ খুনের তাণ্ডব যে শুধু ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য হতো তা কিন্তু নয়; অনেক লোক এতে যোগ দিত এ কারণে যে তারা ইহুদিদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা ধার নিয়েছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই ইহুদিগুলো মারলে বা তাড়ালে তাদের আর ধারটা শোধ করতে হবে না। পোপ ক্লেমেন্ট (ষষ্ঠ) অনেক অনুরোধ ও আবেদন করেও এ ইহুদি নিধনযজ্ঞ থামাতে পারেননি।
ইহুদি ছাড়াও লোকদের সন্দেহ পড়ে গিয়ে যাযাবর জাতির মানুষ এবং তুর্কিদের ওপর। কিছু শহর সে সময় বহিরাগতদের আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে প্লেগ না ছড়ায়। কিন্তু রোগটা যে আসছে ইঁদুরের গায়ে থাকা উপমক্ষিকা থেকে, সেটা তখন কারোরই জানা ছিল না। ফলে বাইরের মানুষ আটকালেও রোগটা আটকানো যাচ্ছিল না এবং এর থেকেই জন্ম নেয় নানা রকমের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। 
ব্ল্যাক ডেথের ২০০ বছর পরও কিন্তু প্লেগ মাঝেমাঝেই দেখা দিত, যদিও তার প্রকোপ ছিল কম। ফলে প্লেগ সম্পর্কে একটা আতঙ্ক রয়েই যায় সাধারণ মানুষের মনে। অনেকেই মনে করত, শয়তানের অশুভ প্রভাব সমাজের ওপর থেকে পুরোপুরি সরে যায়নি এবং ব্ল্যাক ডেথ যেকোনো সময়ই আবার ফিরে আসতে পারে। এ ধারণা থেকেই শুরু হয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর উইচ-হান্টিং, যাতে প্রধান অভিযুক্তরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নারীরা।  
খুব রক্ষণশীল হিসাব নিয়ে বলা হয়,  ৯০ হাজার জনকে ডাইনি হওয়ার অপরাধে সে সময় পুড়িয়ে মারা হয় ইউরোপে। ঠিক যেভাবে ইহুদিদের ব্ল্যাক ডেথের সময় প্রথমে অত্যাচার, তারপর বিচার এবং শেষে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো, ঠিক একই পদ্ধতিতে কথিত ডাইনিদের ধরে সাজা দেয়া হতো। এক্ষেত্রেও অনেক সময় কোনো মেয়েকে ডাইনি অভিযুক্ত করার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকত। ততদিনে অনেক মেয়েই উপার্জন করতে শুরু করেছে, অনেকে বেশ ধনীও—তাদের প্রতি ঈর্ষা এবং তাদের সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত করার একটা প্রয়াস ছিল এর পেছনে। কাউকে ‘ডাইনি’ বলার পেছনে কারণ বা প্রমাণ দেখানোর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকত না—নিছক অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের ধরে নিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। যেসব মেয়ে সন্তান চায় না, তাদেরও ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হতো, যাতে তারা অন্য মেয়েদের প্রভাবিত না করতে পারে। অনেক ধাত্রীও ছিল এই উইচ-হান্টারদের শিকারের তালিকায়। বিশেষত, কোনো গর্ভবতী নারীর যদি গর্ভপাত হতো বা সন্তান জন্মেই মারা যেত, সেই ধাত্রীদের ডাইনি বলা হতো অনেক সময়ই। তাছাড়া ধাত্রীদের সন্দেহ করার একটা বড় কারণ ছিল এই যে তারা মেয়েদের জন্মনিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত। এছাড়া সে সময় মেয়েরা, যারা স্বাধীনচেতা, তাদের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের নামে দাবিয়ে রাখার একটা পরিকল্পনাও ছিল এই উইচ-হান্টিংয়ের পেছনে। দেখানো হতো যে মেয়েরা মানসিকভাবে দুর্বল এবং সেজন্য তারা সহজে শয়তানের কবজায় চলে যায়। গ্রাম বা শহরে কোথাও প্লেগ দেখা দিলে, মড়ক লাগলে বা চাষের ক্ষতি হলে, এমনকি পাড়ার কুয়োর জল খেয়ে কারোর শরীর খারাপ হলেও খোঁজ পড়ত কোনো নারীর (বিশেষ করে বয়স্ক নারী যারা একা থাকেন), যাকে ডাইনি বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। 
ডাইনি অপবাদ দিয়ে যেসব মেয়ের ওপর অকথ্য অত্যাচার হতো, তাদের মধ্যে  অনেকেই এ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেদের ডাইনি বলে স্বীকার করে নিতেন। Malleus Maleficarum নামে একটা বই লেখা হয় ১৪৮৬ সালে,  যাতে ডাইনিদের লক্ষণ বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে এবং এটাও বলা আছে, তাদের ওপর কী কী অত্যাচার করতে হবে। 
চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের সমাজের কিছু মানুষকে এভাবে নিগ্রহ করার পেছনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক—এমন অনেক কারণই আছে। কিন্তু এর সূত্রপাত হয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ নামক রোগটি থেকে তৈরি সর্বগ্রাসী আতঙ্ক থেকে। পরবর্তীকালে এ আতঙ্ক ও কুসংস্কারকে ইন্ধন জোগায় ঈর্ষা, লোভ অথবা সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার, তাদের পদানত করে রাখার প্রবণতা। মৃত্যু শুধু নয়, এই ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপে এনেছিল এক নৃশংস মানসিকতাকে, যার চূড়া স্পর্শকারী নিষ্ঠুরতা সম্ভবত নিরপরাধী অসহায় মেয়েদের ডাইনি সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারার প্রথাটি।  

মণিদীপা দে: ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভ্রমণবিষয়ক লেখিকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন